অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট কী? রোজিনার বিরুদ্ধে করা মামলা অবৈধ! দৈনিক প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা দায়ের করার পর তিনি এখন কারাগারে রয়েছেন।
সোমবার সচিবালয়ের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি কক্ষে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে প্রায় পাঁচ ঘন্টা আটকে রেখে শারীরিকভাবে হেনস্তা করার অভিযোগ উঠেছে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ- তিনি সরকারের গোপন নথির ছবি তুলেছেন এবং সেগুলো সরিয়ে নিতে চেয়েছেন।
যদিও রোজিনা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন; সহকর্মীরা দাবি করছেন, স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি নিয়ে আলোচিত কিছু প্রতিবেদনের জন্য তিনি আক্রোশের শিকার হয়েছেন।
রোজিনার বিরুদ্ধে করা মামলায় ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩৭৯ ও ৪১১ ধারায় চুরির অভিযোগ আনা হয়েছে। এই দুটি ধারার সর্বোচ্চ সাজা ৩ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড।
১৯২৩ সালের ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের’ ৩ ও ৫ ধারায় গুপ্তচরবৃত্তি ও রাষ্ট্রীয় গোপন নথি নিজের দখলে রাখার অভিযোগও আনা হয়েছে।
৩ ধারা অনুযায়ী অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড। আর ৫ ধারা অনুযায়ী সাজা মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে অথবা ১৪ বছরের কারাদণ্ড। তবে সর্বনিম্ন সাজা ৩ বছরও হতে পারে।
অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট মূলত একটি ঔপনিবেশিক আইন। ব্রিটিশ শাসনামলে এই আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল।
১৮৯৯ সাল থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত লর্ড কার্জন যখন ভারতবর্ষের ভাইসরয় ছিলেন তখন এই আইন প্রণয়ন করা হয়। বেশ কয়েক-দফা সংশোধিত হয়ে ১৯২৩ সালে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট জারি করা হয়।
এই আইনটি পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে , এর দুইটি দিক রয়েছে। একটি হচ্ছে গুপ্তচরবৃত্তি এবং অপরটি হচ্ছে সরকারের গোপন নথি ফাঁস।
তবে এই আইনের কোথাও উল্লেখ করা নেই যে সরকারি গোপন নথি সংবাদপত্রে প্রকাশ করা যাবে না।
আইনে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা এবং স্বার্থের পরিপন্থী কোন উদ্দেশ্য নিয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করে তাহলে তার শাস্তি হবে। অর্থাৎ, সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ কোনো এলাকায় গমন করে, পরিদর্শন করে বা ভেতরে প্রবেশ করে তাহলে শাস্তি হবে।
বাংলাদেশের একজন সিনিয়র সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ বলেন, সচিবালয় কোনো নিষিদ্ধ জায়গা নয়। সেখানে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকারের জন্য সরকার পরিচয়পত্র দিয়েছে এবং সরকার জানে যে সেখানে সাংবাদিকরা তথ্য সংগ্রহের জন্য যাবে।
অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট অনুযায়ী গোপন নথি বলতে বোঝানো হয়েছে অফিসিয়াল কোড, পাসওয়ার্ড, স্কেচ, নকশা, প্ল্যান, বিভিন্ন ধরনের নথি। শত্রুপক্ষের ব্যবহারের জন্য কোনো ব্যক্তি যদি এগুলো সংগ্রহ বা রেকর্ড করে তাহলে এটি অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট মূলত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সাথে সম্পর্কিত। এই আইনের বিশেষ কিছু দিক হচ্ছে নিম্নরূপ।
১. প্রহরারত পুলিশ বা সেনাবাহিনী সদস্যদে কাজে হস্তক্ষেপ করা যাবে না
২. কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রের পরিপন্থী উদ্দেশ্যে সরকারি দলিল নিজের অধিকারে রাখতে পারবে না।
৩. বিদেশি এজেন্টের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারবে না
৪. মিথ্যা পরিচয় দিয়ে পুলিশ, সেনাবাহিনী কিংবা অন্যান্য বাহিনীর পোশাক পরতে পারবে না।
৫. নিরাপত্তার স্বার্থে সরকার কোনো এলাকাকে সংরক্ষিত বা নিষিদ্ধ করলে সে এলাকার ছবি, স্কেচ ,নোট বা মডেল আঁকতে পারবে না।
এই আইনে বলা হয়েছে, তথ্য পাচার এবং তথ্য গ্রহণকারী- উভয়পক্ষ এর ফলে দণ্ডিত হতে পারেন। এই আইনের অধীনে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড বা ১৪ বছর পর্যন্ত সাজা এবং সর্বনিম্ন তিন বছরের সাজার বিধান রয়েছে।
সাংবাদিকদের অভিযোগ, সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার জন্য বিভিন্ন সময় নানা আইন করেছে সরকার।
প্রায় ১০০ বছর আগে ব্রিটিশ আমলে যখন এই আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছিল, তখনকার সামাজিক বাস্তবতা এবং বর্তমান সামাজিক বাস্তবতা এক নয়।
আইনজীবী এবং সাংবাদিকরা বলছেন, স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এই আইন প্রয়োগের নজির নেই।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলেন, ব্রিটিশদের প্রশাসনে ভারতবর্ষের অনেকে কাজ করত। তাদের প্রতি ব্রিটিশদের এক ধরনের অবিশ্বাস ছিল। তারা যাতে প্রশাসনের কোনো গোপন নথি বা তথ্য পাচার বা প্রকাশ করতে না পারে সেজন্য অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট প্রণয়ন করা হয়েছিল। প্রশাসনের গোপনীয়তা রক্ষা করা ছিল এই আইনের উদ্দেশ্য।
মোরশেদ বলেন, গোপনভাবে তথ্য সংগ্রহ করা তো সাংবাদিকতার অধিকার। এটা ছাড়া তো সাংবাদিকতা চলে না। অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট সাংবাদিকতা ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
অন্য দেশের উদাহরণঃ
ভারতে ২০১৮ সালে মাধুরী গুপ্তা নামে একজন কূটনীতিক অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের আওতায় দণ্ডিত হয়েছিলেন।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছিল, ইসলামাবাদে পাকিস্তান হাই কমিশনে কর্মরত অবস্থায় পাকিস্তানি গুপ্তচর আইএসআইকে তথ্য পাচার করেছিলেন। এই মামলায় তাকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।
গত ২০ বছরে ভারতে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের আওতায় কয়েকজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হলেও আদালতে সেগুলো খারিজ হয়ে যায়।
এর মধ্যে অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে , শান্তনু সাইকিয়া। ভারতের মন্ত্রিসভার একটি গোপন নথি ফাঁস হয়ে যাবার ভিত্তিতে সাইকিয়া একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। তার বিরুদ্ধে তখন অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা হয়।
সেই মামলা থেকে সাইকিয়াকে অব্যাহতি দিয়ে দিল্লি হাইকোর্ট বলেছিল, কোনো নথি ফাঁস হলে সেটিকে গোপন আখ্যা দিয়ে একজন সাংবাদিককে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের আওতায় দোষী করা যায় না। সূত্র বিবিসি বাংলা
আরও পড়ুন:সাংবাদিক রোজিনার মুক্তির দাবিতে বরিশাল তরুণ
আরও পড়ুন:রোজিনা নীতিহীন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের সূচনা করেছেন: এনডিবি
যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন।