কুরবানীর দিনের আমল ফিরোজ মাহমুদ :: কুরবানীর দিন এক মহান দিন। এই দিনকে ‘হজ্জে আকবার’ এর দিন বলা হয়।[আবু দাউদ] এই দিন সারা বছরের শ্রেষ্ঠতম দিন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহর নিকট মহানতম দিন কুরবানীর দিন। অতঃপর স্থিরতার (কুরবানীর পরের) দিন।[ইবনে মাজাহ]
কুরবানীর ঈদ বা ঈদুল আযহা, রোযার ঈদ বা ঈদুল ফিতর অপেক্ষা উত্তম। কারণ, ঈদুল আযহাতে নামায ও কুরবানী আছে। কিন্তু ঈদুল ফিতরে আছে নামায ও সদকাহ। আর কুরবানী সদকাহ অপেক্ষা উত্তম। আবার কুরবানীর দিনে হাজীদের জন্য স্থান ও কালের মাহাত্ম্য ও পবিত্রতা একত্রিত হয়। যেহেতু ঐ সময় পবিত্র কাবাগৃহের হজ্জ হয়। আর যার পূর্বে আরাফার দিন ও পরে তাশরীকের তিন দিন। আর এই দিনগুলির প্রত্যেকটাই হাজীদের জন্য ঈদ।
১.এই দিনে সুন্দর পোষাক ও বেশ-ভুষায় সজ্জিত হয়ে উত্তম খোশবু মেখে ঈদগাহে যাওয়া সুন্নত। যেহেতু এই দিন সৌন্দর্য ও সাজ-সজ্জার দিন। যেমন ঈদের জন্য গোসল করা কিছু সলফ, সাহাবা ও তাবেঈন কর্তৃক শুদ্ধভাবে প্রমাণিত আছে।[ ফাতহুল বারী]
২.খুবই সকাল সকাল ঈদগাহে পৌঁছে ইমামের নিকটবর্তী স্থানে বসার চেষ্টা করবে মুসলিম। এতে নামাযের জন্য প্রতীক্ষার সওয়াব লাভ করবে।
৩. ঈদগাহে যাবার পথে তকবীর পাঠ করা। ইমাম বের হওয়া (নামাযে দাঁড়ানো) পর্যন্ত ঐ তকবীর পড়া সুন্নত। যুহরী বলেন, লোকেরা ঈদের সময় তকবীর পাঠ করত, যখন ঘর হতে বের হত তখন থেকে শুরু করে ঈদগাহ পর্যন্ত পথে এবং ইমাম বের হওয়া পর্যন্ত ঈদগাহে তকবীর পড়ত। ইমামকে (নামাযে দাঁড়াতে) দেখে সকলেই চুপ হয়ে যেত। পুনরায় ইমাম যখন (নামাযের) তকবীর পড়তেন তখন আবার সকলে তকবীর পড়ত।[ ইবনে আবী শাইবাহ]
৪. ঈদগাহে পাঁয়ে হেঁটে যাওয়াই সুন্নত। অবশ্য ঈদগাহ দূর হলে অথবা অন্য কোন ওজর ও অসুবিধার ক্ষেত্রে সওয়ার হয়েও যাওয়া চলে।[ মাজমূ ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়্যাহ]
ঈদুল আযহার দিন নামাযের পূর্বে কিছু না খাওয়া সুন্নত। আর ঈদুল ফিতরের দিন ইদগাহে বের হওয়ার পূর্বে কিছু খাওয়া সুন্নত।[তিরমিযী]
ইবনুল কাইয়েম বলেন, ‘তিনি ঈদুল আযহার দিন ঈদগাহ থেকে ফিরে এসে (কুরবানী করে) কুরবানীর (গোশত) খেতেন।’[যা’দুল মাআদ]
প্রকাশ থাকে যে, ঈদুল আযহার দিনে নামাযের পূর্বে না খাওয়ার নাম হাফ রোযা নয়। আর এই রোযার জন্য ফজরের পূর্বে সেহরী খাওয়াও বিধেয় নয়। পক্ষান্তরে জানা কথা যে, হাফ বলে কোন রোযা শরীয়তে নেই এবং ঈদের দিন রোযা রাখা হারাম।
৫. ঈদের নামাজ আদায় করা:
এই নামায সুন্নতে মুআক্কাদা। কোন সক্ষম মুসলিমের জন্য তা ত্যাগ করা বা আদায় করতে অবহেলা করা উচিত নয়। শিশুদেরকেও এই নামাযে উপস্থিত হতে উদ্বুদ্ধ করবে। সৌন্দর্য প্রকাশ না হলে, পর্দার রীতি থাকলে এবং পথে ও ঈদগাহে নারী-পুরুষে মিলা-মিশার ভয় না থাকলে মহিলারা জামাআতে শামিল হবে। বরং পর্দার ব্যবস্থা করে ঈদগাহে মহিলাদেরকে উপস্থিত হয়ে নামায পড়ার বন্দোবস্ত করা জরুরী।
দুর্ভাগ্যবশত যদি জামাত ছুটে যায় তা হলে করণীয়;ঈদের নামাযের জামাআত ছুটে গেলে একাকী দুই রাকআত নামায পড়ে নেবে।[ফাতহুল বারি] ঈদের খুতবাহ শোনা সুন্নত। তবে উপস্থিত থেকে তাতে লাভবান হওয়া উচিত। খুতবাহ শেষে (যে পথে গিয়েছিল তার) ভিন্ন পথে বাড়ি ফিরবে।[বুখারী]
৬. কুরবানী যবেহ ও গোশত বিতরণ:
কুরবানী যবেহর সময় ঈদের খুতবা শেষ হলে শুরু হয়। কুরবানী দাতার জন্য সুন্নত যে, সে তা হতে খাবে, আত্মীয়-সবজনকে (তারা কুরবানী দিক, চাই না দিক) হাদিয়া দেবে এবং গরীবদেরকে সদকাহ করবে। আল্লাহ তাআলা এ বিষয়ে বলেন,অতঃপর তোমরা তা হতে ভক্ষণ কর এবং নিঃসব অভাবগ্রস্তদেরকে ভক্ষণ করাও। (সূরা হাজ্জ ২৮ আয়াত)
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, (কুরবানীর গোশত) তোমরা খাও, জমা কর, এবং দান কর।’’ তিনি আরো বলেন, ‘‘তা খাও, খাওয়াও এবং জমা রাখ।’’ [ মুসলিম] তবে অধিকাংশ উলামাগণ মনে করেন যে, সমস্ত গোশতকে তিন ভাগ করে এক ভাগ খাওয়া, এক ভাগ আত্মীয়-সবজনকে হাদিয়া দেওয়া এবং এক ভাগ গরীবদেরকে দান করা উত্তম।
৭. ঈদের মুবারকবাদ:
ঈদের দিন এক অপরকে মুবারকবাদ দেওয়ায় ও শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করা উচিত। যেমন, ‘তাক্বাব্বাল্লাহু মিন্না অমিনকুম’ (আল্লাহ আমাদের ও আপনাদের নিকট থেকে ইবাদত কবুল করেন), ঈদ মুবারক ইত্যাদি দুআমূলক বাক্য বলে এক অপরের সাথে সাক্ষাৎ করা বৈধ। তবে মনে রাখতে হবে যে বেগানা নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরীর অবাধ মিলামিশা, পর্দাহীনতা, নারীদের নানান সাজ-সজ্জা ও অঙ্গরাগে সুগন্ধ মেখে গায়ের মাহরাম (গম্য) পুরুষদের সাথে সাক্ষাৎ ও মুসাফাহাহ করা, খেলা, ছবি তোলা ইত্যাদি হারাম।
আরো পড়ুন: কি ভাবে শুদ্ধ হবে আমার কুরবানি!
৮. ১১, ১২ ,১৩ই যুলহজ্জ তাকবির ও তাশরিক পাঠ করা:
প্রতি ফরয নামাযের পর তকবীর পাঠ। যা তাশরীকের শেষ দিনের আসর পর্যন্ত পড়তে হয়। অবশ্য অনেক উলামাগণ মনে করেন যে, তকবীর কেবল নামাযের পরেই সুনির্দিষ্ট নয়। বরং এই দিনগুলিতে যে কোন সময় সর্বদা পড়াই উত্তম।এই দিনগুলোকে ‘আইয়্যামে তাশরীক’ বলা হয়। তাশরীকের অর্থ হল, রৌদ্রে গোশত শুকানো। যেহেতু এই দিনগুলিতে কুরবানীর গোশত বেশী দিন রাখার জন্য রৌদ্রে শুকানো হত, তাই উক্ত দিনগুলির এই নামকরণ হয়।
তাকবিরে তাশরিক হলো–আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, অল্লহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ। আল্লাহ আমাদের আমলগুলোকে কবুল করুন এবং সঠিকভাবে আমল করার তৌফিক দান করুন–আমীন।
লেখক: ইসলামী গবেষক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।
যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন।