কোরবানির তাৎপর্য ও ইতিহাস মুসলমানদের সর্ববৃহৎ ঈদ উৎসব ঈদুল আযহা বা কুরবানীর ঈদ। আদি পিতা হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু হওয়া এ কুরবানীর মূল দীক্ষাই হল সকল প্রকার ঠুনকো, খোঁড়া যুক্তি ও বুদ্ধির ঊর্ধ্বে উঠে আল্লাহর হুকুম আহকামের প্রতি পূর্ণ আত্মসমার্পণ করা। আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের নমুনাস্বরূপ হযরত ইবরাহীম (আ.) নিজ প্রিয় পুত্র ইসমাইলকে (আ.) আল্লাহর রাহে উৎসর্গ করতে গিয়েছিলেন। আল্লাহর হুকুমের প্রতি অতিশয় আনুগত্যের কারণে আল্লাহ তায়ালা তার এ কুরবানীকে কবুল করে নেন, এ ঘটনা আল্লাহর হুকুমের পূর্ণ আনুগত্যতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
ঈদুল আযহা ও কুরবানী: হজ্জ্বের মৌসুমে উদযাপিত এ ঈদকে ইসলামী পরিভাষায় ঈদুল আযহা বলা হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) একে ঈদুল আযহা নামে নামকরণ করেছেন। এছাড়া ইয়াওমুন নহরও বলা হয়। জর্দান, ফিলিস্তিন, লেবানন, মিশর, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, ইরাক, লিবিয়া ও জাজীরার অধিবাসীরা এ ঈদকে ‘ঈদুল কাবীর’ বা বড় ঈদ নামে সম্বোধন করে থাকেন। বাহরাইনের লোকেরা ‘ঈদুল হুজ্জাজ’ বা হাজীদের ঈদ নামে সম্বোধন করেন। আর ইরান, আফগানিস্তানসহ এ উপমহাদেশের লোকেরা ‘ঈদুল কুরবান’ বা কুরবানীর ঈদ নামে অভিহিত করেন।
আযহা শব্দটিকে আরবীতে ‘কুরবান’ও বলা হয়ে থাকে, যা ফারসী বা উর্দূতে ‘কুরবানী’ রূপে পরিচিত হয়েছে। কুরবানের শাব্দিক অর্থ হল- নৈকট্য অর্জন করা, কাছাকাছি যাওয়া। পারিভাষিক অর্থে ‘কুরবানী’ ঐ মাধ্যমকে বলা হয়, যার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য হাছিল হয়। প্রচলিত অর্থে, ঈদুল আযহার দিন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে শারঈ তরীকায় যে পশু যবেহ করা হয়, তাকে ‘কুরবানী’ বলা হয়।
কুরবানীর গুরুত্ব ও তাৎপর্য: কুরবানীর গুরুত্ব অপরিসীম। পবিত্র কুরআন ও হাদীস এ ব্যাপারে ব্যাপক গুরুত্বারোপ করেছে। মহান আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় হাবীবকে লক্ষ করে বলেন, ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে ছালাত আদায় কর এবং কুরবানী কর’(কাওছার-২)। কাফির-মুশরিকরা তাদের দেব-দেবী ও মূর্তির উদ্দেশ্যে কুরবানী করে থাকে। তার প্রতিবাদ স্বরূপ এ আয়াতের মাধ্যমে মুসলমানদের আল্লাহর জন্য ছালাত আদায়ের ও তাঁর উদ্দেশ্যে কুরবানী করার হুকুম দেওয়া হয়েছে। মুফাসসিরদের কারো কারো মতে, এ আয়াতে বিশেষভাবে ঈদুল আযহার নামাজ ও নামায শেষে কুরবানীর নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
কুরবানীর ইতিহাস খুবই প্রাচীন। সেই আদি পিতা আদম (আলাইহিস সালাম)-এর যুগ থেকেই কুরবানীর বিধান চলে আসছে। আদম (আলাইহিস সালাম)-এর দুই ছেলে হাবীল ও কাবীলের কুরবানী পেশ করার কথা আমরা মহাগ্রন্থ আল-কুরআন থেকে জানতে পারি।
মহান আল্লাহ বলেন, অর্থাৎ, আদমের দুই পুত্রের (হাবিল ও কাবিলের) বৃত্তান্ত তুমি তাদেরকে যথাযথভাবে শুনিয়ে দাও, যখন তারা উভয়ে কুরবানী করেছিল, তখন একজনের কুরবানী কবুল হল এবং অন্য জনের কুরবানী কবুল হল না। তাদের একজন বলল, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। অপরজন বলল, আল্লাহ তো সংযমীদের কুরবানীই কবুল করে থাকেন।[সূরা মায়েদা:২৭]
কুরবানীর বিধান প্রত্যেক জাতির জন্যই ছিল। মহান আল্লাহ বলেন, অর্থাৎ, আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানীর বিধান দিয়েছি; যাতে আমি তাদেরকে জীবনোপকরণ সবরূপ যে সব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছি সেগুলির উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।
তোমাদের উপাস্য একমাত্র উপাস্য। সুতরাং তোমরা তাঁরই নিকট আত্মসমর্পণ কর। আর সুসংবাদ দাও বিনীতগণকে; যাদের হূদয় ভয়ে কম্পিত হয় আল্লাহর নাম স্মরণ করা হলে, যারা তাদের বিপদ-আপদে ধৈর্যধারণ করে, নামায কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রুযী দিয়েছি তা হতে ব্যয় করে।[সূরা হাজ:৩৪-৩৫]
ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর কুরবানীর আদর্শ হওয়ার ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, অর্থাৎ, অতঃপর সে (ইসমাঈল) যখন পিতা (ইবরাহীমের)র সাথে চলা-ফিরার (কাজ করার) বয়সে উপনীত হল, তখন ইবরাহীম তাকে বলল, ‘হে বেটা! আমি সবপ্নে দেখি যে, তোমাকে যবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কি দেখ।’ সে বলল, ‘আববা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি তা পালন করুন।
আরো পড়ুন: বরকতময় মাস জিলহজ প্রথম দশ দিনের আমল (১ম দিন)
আরো পড়ুন: সহি হাদিসের আলোকে জিলহজ্ব মাসের আমল (২য় দিন)
ইনশাআল্লাহ, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলরূপে পাবেন।’ অনন্তর পিতা-পুত্র উভয়েই যখন আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইবরাহীম তাকে যবেহ করার জন্য অধোমুখে শায়িত করল, তখন আমি ডেকে বললাম, ‘হে ইবরাহীম! তুমি তো স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করে দেখালে। আমি এভাবেই সৎকর্মীদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আর আমি তার পরিবর্তে যবেহ করার জন্য এক মহান জন্তু দিয়ে তাকে মুক্ত করে নিলাম। আর তার জন্য এ বিষয়টি পরবর্তীদের জন্য স্মরণীয় করে রাখলাম।[সূরা সাফফাত ১০২-১০৮]
প্রকাশ যে, স্বপ্ন দেখে ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর ৩ সকাল উঁট কুরবানী করার কথা শুদ্ধ নয়।
লেখক: ইসলামিক গবেষক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।
যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন।