আমি একজন প্রবাসী। প্রবাস কথাটা শুনলেই কলিজার পাশ কাটিয়ে একটা দাগ কেটে যায়। যখন দেশে ছিলাম তখন আমার বাবা ছিলেন একজন প্রবাসী। বাবার কাছে কত চাহিদা ছিল, সব চাহিদা বাবা হাসিমুখে পূরণ করতেন।
তাই আমিও ভেবে নিয়েছিলাম প্রবাসে মনে হয় অনেক সুখ আর টাকা বাতাসে ওড়ে। তাই বাতাসের উড়ন্ত টাকা ধরতে চলে এলাম প্রবাসে; আর আমার নাম হয়ে গেল প্রবাসী। প্রবাসে আসার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে গিয়েছিলাম জীবন কী জিনিস।
যেদিন এসেছিলাম তার পর দিন থেকেই কাজ শুরু করেছিলাম। ভালো প্যান্ট-শার্ট পরে যখন গাড়িতে করে কাজের স্থানে নিয়ে গিয়েছিল, তখন মনের সব স্বপ্ন চোখ দিয়ে বের হয়ে ওড়ে গেল ওই নীল আকাশে- যেখানে স্বপ্ন দেখতাম চেয়ার-টেবিলে বসে অফিস করব।
- আরো পড়ুন: প্রবাস জীবন: এক ভাইয়ের বাস্তাব ব্যর্থ জীবন থেকে নেওয়া
- আরো পড়ুন: অস্ট্রেলিয়ার প্যারেন্ট ভিসার নীতিমালা
- আরো পড়ুন: কীভাবে দক্ষিণ কোরিয়ায় অভিবাসী হবেন
এভাবেই প্রতিটা প্রবাসী একদিন তার নিজ স্বপ্নগুলোর কথা নিজের অজান্তেই ভুলে যায়। যতই দিন যায় ততই চাহিদা বাড়ে; কিন্তু বেতন বাড়ে চাহিদার ১ শতাংশ।
একটা প্রবাসীর কাঁধের ওপর ভর করে কয়েকটা জীবন স্বপ্ন সাজায় ভালো থাকার। প্রবাসী ছেলেটা হাজারো কষ্টের বিনিময়ে পরিবারের জন্য মাস শেষে টাকা পাঠায়, বসের কাছে প্রতিদিন কত কথা শুনতে হয় তা শুধু যারা প্রবাসে থাকেন তারাই জানেন।
সারা দিন কাজ করে বাসায় ফিরে কাপড় পরিষ্কার করতে হয়, রান্না করতে হয়, গোসল করে বাড়িতে ফোন দিয়ে সবার খোঁজখবর নিতে হয়- তাও হাসিমুখে।
কিন্তু বাড়ি থেকে শুনতে হয় শুধু চাহিদার কথা। এই মাসে এত লাগবে, এই খরচ ওই খরচ শুধু খরচ আর খরচ। আর সেই চাহিদার বোঝা মাথায় নিয়ে যখন ছেলেটা ঘুমাতে যায়, তখন আর ঘুম আসে না চিন্তায়। রাত শেষ হয়ে ভোর হয়। আবার কাজ শুরু সকাল ৮ থেকে রাত ৯টা-১০টা। এভাবেই চলতে থাকে একজন প্রবাসীর গল্প।
আজ একজন ছেলের এক মাসের ইতিহাস লিখব এখানে। ছেলেটার নাম আব্দুল্লাহ, বাড়ি টাঙ্গাইল। সিঙ্গাপুর থাকে চার বছর হল।
ছেলেটার মনে অনেক অভিমান, সেগুলো এখানে নাইবা বললাম। প্রতি মাসে ওর ফ্যামিলি বেতন পাওয়ার আগেই চাপে রাখে টাকার জন্য। আব্দুল্লাহ আমার সঙ্গেই থাকে। ওকে আমার অনেক ভালো লাগে। দেখতে সুন্দর, খোঁচা খোঁচা দাড়িগোঁফ। একসময় ক্লাসের ফাস্ট বয় ছিল। এসএসসি ও এইচএসসিতে এ-প্লাস ছিল। সংসারের অভাবের তাড়নায় সে আজ প্রবাসী।
- আরো পড়ুন: কুয়েত আগুনে ৩ বাংলাদেশির মৃত্যু
- আরো পড়ুন: পর্তুগালে নার্সারি থেকে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন?
- আরো পড়ুন: নরওয়েতে উচ্চশিক্ষাঃ জেনে নিন বিস্তারিত
আমি ওর সুপারভাইজার হওয়ায় আর বড় ভাইয়ের স্নেহ দেয়ায় সে সব কিছু শেয়ার করত আমার সঙ্গে। গত কয়েক মাস ধরে আব্দুল্লাহ মনমরা হয়ে থাকত। বেতন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব টাকা দিয়ে দিতে হয়। কয়েক দিন হল আব্দুল্লাহ চুপচাপ হয়ে গেছে; কিছু জিজ্ঞেস করলেই চোখ ছলছল করে ওঠে আর বলে ভাই- স্যালারি দেবে কবে?
প্রতি মাসের ৬-৭ তারিখ বেতন আসে; কিন্তু আজ ১০ তারিখ বেতন আসেনি। বাড়ি থেকে একটু পর পর ফোন দিচ্ছে টাকার জন্য। ওর খাবার টাকাও শেষ। কাজে আসার জন্য প্রতিদিন বাস ভাড়ার টাকা তাও শেষ এক সপ্তাহ আগেই। এক সপ্তাহ আগে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি রেডি হয়ে বসে আছে, কিন্তু রুম থেকে বের হচ্ছে না।
কাছে যেতেই বলল ভাই কাজে যেতে পারব না। পরে ২০ ডলার দিয়ে কাজে যেতে বললাম। আজকে ১০ তারিখ হয়ে গেছে কিন্তু বেতন আসেনি, টাকাও নাই। লজ্জায় বা যে কোনো কারণে আমাকেও কিছু বলেনি। একা একাই রুম থেকে চুপ করে বের হয়ে গেল।
ট্রেন স্টেশন এসে আব্দুল্লাহ আশায় আছে যদি কোনো পরিচিত কেউ আসে তার কাছ থেকে ২ ডলার নিয়ে টিকিট কেটে আসবে। কিন্তু পরিচিত কাউকে পায়নি, তাই অপরিচিত কয়েকজন বাংলাদেশি ভাইয়ের কাছে হাত পেতেও ২ ডলার পায়নি। কিন্তু সে মাস শেষে ঠিকই ৮০ হাজার টাকা বেতন পায়।
আব্দুল্লাহ তখন নিরুপায় হয়ে এক সিঙ্গাপুরিয়ান মহিলার কাছে ২ ডলার চায়। লিখতে গিয়ে আমার চোখের জল ফোনের ডিসপ্লেতে পড়ছে। কি বলব ভাই বিশ্বাস করেন সঙ্গে সঙ্গে ওই ভদ্রমহিলা ১০ ডলার দিয়ে বলল ‘বেবি ইউ হ্যাভ ফুড মানি?’
এই কথা বলার পর আব্দুল্লাহ সঙ্গে সঙ্গে কান্না শুরু করল। ভদ্রমহিলা আবারও বলল- ‘ডন্ট ক্রাইং মাই বেবি’ প্লিজ টেল মি এনি মোর প্রবলেম? আব্দুল্লাহ আবেগে থ্যাংকস ছাড়া আর কিছুই বলতে পারেনি।
যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে।