মা হওয়ার সবচেয়ে ভালো বয়স কখন? দুর্বা ডেস্ক :: এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে জন্ম দেবার ক্ষমতা নারীকে দেয়া প্রকৃতির একটি সুন্দর উপহার। কিন্তু গর্ভধারণ করার উপযোগী বয়সটা খুব দ্রুতই চলে যায়। এমন নারী খুঁজে পাওয়া খুব দুষ্কর যিনি মা হওয়া এবং পরিবার গঠনের ব্যাপারে সমস্যার সম্মুখীন হন না। বিশের কোঠায় সন্তান ধারণের জন্য একজন নারী সবচেয়ে উর্বর থাকেন। কিন্তু গর্ভাবস্থা এবং অভিভাবকত্ব সামলানোর জন্য এই বয়সটি সবার জন্য আদর্শ নাও হতে পারে। এমনকি কেউ কেউ ৩০ বছর বয়সেও তৈরি থাকতে না পারেন। সে কারণে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ এবং মায়েরা সকলেই একমত হন গর্ভবতী হওয়ার সে অর্থে সঠিক কোনও বয়স নেই।
ইলিনয়েস শিকাগোতে বসবাসকারী স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞ ড. ওয়েন্ডি সি. গুডাল ম্যাকডোনাল্ড বলেন, আপনার বয়স যত কম থাকবে বাচ্চাকে দেখাশোনা করার জন্য আপনার তত কম টাকা ও সম্পদ থাকবে। কিন্তু ক্যারিয়ারের শুরুর সময় মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং ছোট বাচ্চাদের জন্য সময় পাবেন। যত বয়স বাড়বে, আপনার তত বেশি টাকা থাকবে কিন্তু প্রয়োজনে গর্ভবতী হওয়ার জন্য সহায়তা নিতে আরও বেশি অর্থ লাগতে পারে। ড. ম্যাকডোনাল্ড আরো বলেন বয়স যত বাড়বে তত বেশি স্যান্ডউইচ জেনারেশনে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে যেখানে একই সাথে বয়স্ক বাবা মা এবং শিশু সন্তানের যত্ন নিতে হবে।
অবশ্যই একজন নারীর গর্ভবতী হবার অনুকূল সময় তখনই যখন তিনি শারীরিক, আবেগগত, মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রস্তুত এবং এই সময়টি একজন থেকে আরেকজনের ক্ষেত্রে একেবারেই আলাদা। গর্ভবতী হওয়ার জন্য কোন বয়স সবচেয়ে ভালো হতে পারে, তা নির্ধারণের জন্য বিশেষজ্ঞ এবং সব বয়সসীমার মায়েদের অভিজ্ঞ মতামতগুলো বিশ্লেষণ করেছিলো গবেষকরা।
বয়স যখন ২০ এর কম
ড. ম্যাকডোনাল্ড ব্যাখ্যা করেন, অবশ্যই এই তরুণ বয়সসীমা অধিকাংশ মহিলার জন্য আদর্শ নয়, যদিও এ সময় একজন নারী সবচেয়ে বেশি সন্তানধারণক্ষম থাকেন। এ সময়ে ওজন কম থাকে যা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো গর্ভকালীন জটিলতা কমায়। কিশোরী, ৩০ এর কোঠার শেষের দিকে এবং ৪০ এর কোঠার শুরুর দিকে প্রিএক্লাম্পশিয়ার হার সবচেয়ে বেশি থাকে। এদিকে আবার এই বয়সে বাচ্চা লালন-পালনের সাথে সাথে অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তাও রাজত্ব করে।
যদিও আটলান্টা জর্জিয়ার ২৯ বছর বয়সী ফেলিশিয়া আই. ১৮ বছর বয়সে গর্ভবতী হন। তিনি জানান, তার এখনও বাচ্চাদের মত মানসিকতা রয়ে গেছে। বলেন, ‘‘আমি প্রচন্ড আবেগতাড়িত ছিলাম যে এত কম বয়সে কিভাবে মা হবো। আমাকে ভুল বুঝবেন না, আমার বাচ্চারা ঈশ্বরপ্রদত্ত উপহার এবং আমার জীবন পরিবর্তন করে দিয়েছে। তবুও যখন আপনার নিজেরই বড় হবার জন্য অনেক কিছু করার আছে তখন মা হওয়া সত্যিই কঠিন।’’ তিনি আরও বলেন, গর্ভাবস্থা এবং প্যারেন্টিং কম চাপযুক্ত হতে পারত যদি তিনি আরও একটু অপেক্ষা করতেন কারণ এখন তিনি আরও পরিপক্ক ও ধৈর্যশীল।
বয়স যখন ২০ থেকে ২৪
এই বয়সসীমার বেশিরভাগ নারীর প্রতি মাসে গর্ভধারণের ২৫ শতাংশ সম্ভাবনা থাকে। আর্থিক সংস্থান তখনও একটি বোঝা যেহেতু অধিকাংশ মানুষ এ বয়সে ২০ এর কোঠার প্রথম দিকে) ছাত্রাবস্থার ঋণ শোধ করে এবং সামান্য পরিমাণে সঞ্চয় করে।
ফ্লোরিডার আটলান্টার বিয়াঙ্কা ডি. (২৭) এর বয়স ছিল ২০ যখন তিনি তার মেয়ের জন্ম দেন, এখন তার বয়স সাত। যখন তার ছেলের জন্ম দেন তখন তার বয়স ছিল ২৫। এখন ছেলের বয়স ২৩ মাস। যদিও তিনি তখনো কলেজে ছিলেন তবু চমৎকার সহায়ক ব্যবস্থার কারণে তিনি তার পড়ালেখা শেষ করতে সক্ষম হন। তিনি বলেন, ‘‘প্রথমবারের গর্ভাবস্থা আমার জন্য সহজ ছিল কারণ আমার বয়স কম ছিল এবং আমি শেইপে ছিলাম।
কিন্তু দ্বিতীয় গর্ভাবস্থায় আমি বাড়ি থেকে কাজ করে মার্কেটিং ইন্ডাস্ট্রিতে উদ্যোক্তা, পুরোপুরি ব্যস্ত ছিলাম এবং সেজন্য আমি কাজে কম সক্রিয় ছিলাম। খুব চাপ ছিল কাজের।” তিনি তার দ্বিতীয় গর্ভাবস্থায় বেশি জটিলতা মোকাবেলা করেন এবং সুস্থ হতে বেশি সময় লেগেছে, যা তার অল্প বয়স এবং লাইফস্টাইলের কারণে হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে গর্ভবতী হবার কখনোই কোনো সঠিক সময় নেই। যদি পরিকল্পনা না করা হয় এটা কখনোই সহজ হবে না।
বয়স ২৫ থেকে ২৯ হলে
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এ সময় প্রতিমাসে অধিকাংশ নারীর গর্ভধারণের ২৫ শতাংশ সুযোগ থাকে।
ফ্লোরিডার মায়ামি ক্রিস্টাল আর. (২৯) বিয়ের পরপরই ২৭ বছর বয়সে গর্ভবতী হবার সিদ্ধান্ত নেন। যদিও অনেকে তাকে অপেক্ষা করার উপদেশ দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘মানুষজন জানেনা যে আমি এবং আমার স্বামী অনেক বছর ধরে এ বিষয়ে কথা বলছি। এটা আমরা সত্যিই চাচ্ছিলাম এবং যতখানি হওয়া যায় ততই ভালো মা হবার জন্য তৈরি ছিলাম।”
জর্জিয়ার আটলান্টার মেডেলিন এম. (৩০) তার প্রথম বাচ্চা জন্ম দেন ২৮ বছর বয়সে এবং দ্বিতীয় বাচ্চার জন্য চেষ্টা করতে তাকে পরিবার থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছিল। তিনি বলেন, ‘‘স্প্যানিশ পরিবারে বড় হওয়ার কারণে মধ্য ত্রিশের আগেই আমার সব বাচ্চা হয়ে যাবার চাপ অনুভব করেছি। সমাজ আমাদের ওপর অনেক চাপ প্রয়োগ করে।”
বয়স ৩০ থেকে ৩৪ এর মধ্যে থাকলে
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যার অধ্যাপক ড. মেরি জেন মিনকিন বলেন আপনার বয়স ৩০ ছুঁয়ে গেলে বিশেষ করে ৩৫ বা তার বেশি হলে আমরা উর্বরতা অভাব দেখতে শুরু করি। কিন্তু এটাই একমাত্র ব্যাপার নয়। যদি আপনি এখনও ক্যারিয়ার প্রতিষ্ঠা করতে ব্যস্ত থাকেন অথবা যোগ্য সঙ্গী খুঁজে না পান তাহলে শুধুমাত্র বাচ্চা পাবার জন্য গর্ভবতী হতে জোর দেওয়া উচিত নয়। অবশ্য আপনি কয়টি সন্তান চান সেটা বিবেচনায় রাখা দরকার।
নিউ ইয়র্কের কেলি এম. (৪৬) তার প্রথম সন্তান গ্রহণ করেন ৩৪ বছর বয়সে। তিনি মনে করেন উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করা এবং জীবনের অন্যান্য অভিজ্ঞতা হবার পেছনে অবশ্যই কিছু বলার আছে। তিনি বলেন, ‘‘বিশের কোঠায় আমি একদম এ ধরনের প্রতিশ্রুতির জন্য তৈরি ছিলাম না যখন আমার অনেক কিছু অর্জন করা বাকি ছিল যা বাচ্চারা বড় হওয়া পর্যন্ত স্থগিত রাখতে চাই নি।”
৩২ বছর গর্ভবতী হওয়া ভার্জিনিয়ার মেগান ই. তার ক্যারিয়ার প্রতিষ্ঠার জন্য সময় নিয়েছিলেন। এতে কোন সন্দেহ নেই যে গর্ভাবস্থায় ভালো থাকতে এবং নির্বিঘ্নে সন্তান জন্ম দিতে আপনার কাজের চাপ কমাতে হবে সাময়িকভাবে হলেও। কিন্তু সন্তান নেবার আগে আমার পুরো ৪টি বছর লেগেছে নিজের পরিচয় তৈরি করতে, যা আমাকে দরকারে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে সাহায্য করেছে। তিনি বলেন, আমি জানতাম আমরা মাত্র ২/১ জন সন্তান নিতে যাচ্ছি তাই আমি কোন তাড়াহুড়ো অনুভব করিনি। কিন্তু যদি কেউ বেশি বাচ্চা চান অথবা বাচ্চা নেবার মধ্যে সময় বাড়াতে চান তাহলে তাড়াতাড়ি সন্তান নেবার চিন্তা বিবেচনা করা যেতে পারে।
বয়স ৩৫ থেকে ৩৯ এর মধ্যে
ড. ম্যাকডোনাল্ড উল্লেখ করেন, দুর্ভাগ্যক্রমে এটাই সত্য যে ৩২ বছরের পর উর্বরতা দ্রুত হ্রাস পেতে শুরু করে এবং ৩৭ এ তা আরও দ্রুত কমে। এর সাথে গর্ভধারণের সহায়তাকারীর সাফল্য যেমন আইভিএফের সাফল্যের হার কমতে শুরু করে, চিকিৎসার খরচ বাড়ায়। স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়তে শুরু করে। যেমন, উচ্চ রক্তচাপ, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস, প্রি একলামশিয়া এবং ক্রোমোজোমের অস্বাভাবিকতা (যদিও এখনও ৪০ বছর বয়সের হার এক শতাংশের কম)। এই বয়স সীমার মহিলাদের গর্ভবতী হবার চেষ্টায় প্রতি ৬ মাসে গাইনোকোলজিস্ট বা REI বিশেষজ্ঞের কাছে সাহায্য নেওয়ার কথা বিবেচনা করা উচিত।
নিউ ইয়র্কের নর্থপোর্টে বসবাসকারী ৪৩ বছর বয়সী মনিকা বি. ৩৫ ও ৩৭ বছর বয়সে পরপর দুই বাচ্চারর জন্ম উপভোগ করেছেন। কারণ তিনি পরিপক্ক হতে এবং অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল হতে সময় পেয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘আমার ছেলের জন্ম হবার সময় আমি ক্যারিয়ারের যে অবস্থানে ছিলাম সেখানে আমার অভিজ্ঞতা ছিল এবং আমি জানতাম কিভাবে কনসাল্টিং বিজনেস শুরু করবো।
সেজন্য আমি আমার নিজের বস হতে পেরেছিলাম এবং নিজের সময় পরিকল্পনা করতে পেরেছিলাম, যা আমি কয়েক বছর আগে সক্ষম ছিলাম না। আমি একটিই নেতিবাচক দিক বলব যে আমাকে আমার চারপাশের অন্যদের চেয়ে বড় বলে মনে হত যা আমাকে বিচ্ছিন্ন করতো কোনভাবে। আমি এখনও মায়েদের জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হই কিন্তু কথোপকথনে আমাদের বয়সের পার্থক্য টের পাই।”
বয়স ৪০ থেকে ৪৫ এর মধ্যে
গ্রীনউইচ ফার্টিলিটি এবং আইভিএফ সেন্টারগুলির একজন প্রজনন এন্ডোক্রিনোলজিস্ট এবং এনওয়াইউ স্কুল অফ মেডিসিনের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিদ্যার অধ্যাপক ড. আনাট ব্রুয়ার ব্যাখ্যা করেন, ‘‘৪০ বছর বয়সে, একজন সুস্থ মহিলার প্রতি মাসে গর্ভবতী হওয়ার সম্ভাবনা ৫ শতাংশেরও কম হয়। এই বয়সের মধ্যে আরও বড় উদ্বেগ হল চিকিৎসা ঝুঁকি। ৪০ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে মহিলাদের গর্ভাবস্থার জটিলতা যেমন অ্যাক্টোপিক গর্ভাবস্থা এবং গর্ভপাত, সেইসাথে পরে প্রিক্ল্যাম্পসিয়া, ডায়াবেটিস, প্লাসেন্টাল সমস্যা যেমন প্লাসেন্টা প্রভিয়া, জন্মের সময় বাচ্চা ওজন কম এবং প্রসবকালীন জটিলতা বাড়ে। পাশাপাশি ভ্রূণের মৃত্যুর হারও বেশি। যদি কোনও নারীর উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা স্থূলত্বের মতো সমস্যা থাকে তবে এই সমস্ত ঝুঁকিও বাড়ে।
নিউইয়র্কের আস্টোরিয়া থেকে আসা ৪৩ বছর বয়সী সুজানা এস, তার মেয়েকে জন্ম দেন তার ৪১তম জন্মদিনের এক মাস আগে। তিনি বলেন, ‘‘আমি খুশি যে আমার মেয়েটি যখন হয়েছিল তখন আমি নিজের জীবনের অর্থ অনুসন্ধান করতে এবং নিজেকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য নিজেকে অনেক বছর দিয়েছিলাম, আমার জীবনের অভিজ্ঞতার কারণে আমি জানি যে আমি আমার মেয়েকে তার জীবনে সত্য এবং সুন্দর কী তা আবিষ্কার করতে, উদ্দেশ্যপূর্ণ এবং ভালবাসার জীবনযাপন করতে তার জীবনের সমস্ত অপ্রয়োজনীয় সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করতে পারি।”
আরো পড়ুন: ক্যারিয়ার হিসেবে জাভাস্ক্রিপ্ট কেন বেছে নিবেন?
বিশেষজ্ঞরা এবং মায়েরা সকলেই সম্মত হন যে ‘‘গর্ভবতী হওয়ার সবচেয়ে ভাল বয়স কখন?” আসলে এই প্রশ্নের সঠিক কোনও উত্তর নেই। জৈবিকভাবে, উত্তরটি সম্ভবত ২০ এর কোঠার প্রথম দিকে, তবে শুধু এই বিষয়টি বিবেচনা করলেই হবে না। মাতৃত্বের সিদ্ধান্ত নেবার জন্য অসংখ্য বিষয় ভেবে দেখবার ও আমলে নেবার আছে। কারণ মানসিক পরিপক্কতা, অর্থনৈতিক স্থিতি, কেরিয়ার, কাজের চাপ সবকিছু মিলিয়েই জীবনের পরিকল্পনা সাজাতে হয়, যা এক একজনের ক্ষেত্রে এক এক রকম। তাই সবচেয়ে ভালো হল-আপনার পক্ষে যা সঠিক মনে হয় তা করা এবং একটি সুন্দর পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়া।
যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন।