স্থূলতা যে ৯ রোগের কারণ

জেনে নিন স্থূলতা যে ৯ রোগের কারণ । আসুন এ বিষয়ে আজকে আলোচনা করে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক। অতিরিক্ত ওজন একসময় স্থূলতায় রূপ নেয়। স্থূলতা এমন একটি অবস্থা যেখানে একজন ব্যক্তির শরীরের ক্ষতিকর চর্বির পরিমাণ বেড়ে যায়। এর ফলে গুরুতর স্বাস্থ্য জটিলতার ঝুঁকি বেড়ে যায়। শরীরের অতিরিক্ত চর্বি হাড় ও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের উপর চাপ ফেলে। এটি হরমোন ও বিপাকক্রিয়ায় জটিল পরিবর্তন ঘটায় ও শরীরে প্রদাহ বাড়ায়।

বর্তমানে স্থূলতা মোকাবিলা করা সবচেয়ে কঠিন জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮০০ মিলিয়ন মানুষ স্থূলতার শিকার। স্থূলতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের বডি মাস ইনডেক্স বা বিএমআই ৩০ বা তার বেশি থাকে। বর্তমানে শুধু প্রাপ্ত বয়স্করাই নয়, স্থূলতায় ভুগছে বিশ্বের লাখ লাখ শিশুরাও। ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ ৯ রোগের কারণ হতে পারে স্থূলতা।



চলুন তবে জেনে নেওয়া যাক স্থূলতা যে ৯ রোগের কারণ:

১. টাইপ ২ ডায়াবেটিসের সমস্যায় এখন অনেকেই ভুগছেন। রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হলে টাইপ ২ ডায়াবেটিস হয়। সময়ের সাথে সাথে এটি হৃদরোগ, স্নায়ুর ক্ষতি, স্ট্রোক, কিডনি রোগ ও চোখের সমস্যা বাড়িয়ে তোলে। স্থূলতা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ৫ থেকে ৭ শতাংশ বাড়িয়ে তোলে। শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ ও নিয়মিত ব্যায়াম টাইপ ২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে পারে।

২. স্থূলতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে হৃদরোগ বেশি হয়। এক্ষেত্রে হৃৎপিণ্ডকে রক্ত সরবরাহকারী ধমনীতে চর্বি জমতে শুরু করে। স্থূলতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের স্বাভাবিক রক্তচাপ, লো-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (এলডিএল) কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইডস ও রক্তে শর্করার পরিমাণ বেশি থাকে। যা হৃদরোগে অবদান রাখে। ধমনী সরু হয়ে গেলে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। সরু ধমনীতে রক্ত জমাট বাঁধার ফলে স্ট্রোক হতে পারে।

৩. স্থূলতা স্ট্রোক ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে স্ট্রোক হয়। স্ট্রোকের কারণে মস্তিষ্কের টিস্যুর ক্ষতি হয়। ফলে বাকশক্তি হারানো ও ভাষার দুর্বলতা, দুর্বল পেশি, চিন্তাভাবনা ও যুক্তির দক্ষতার পরিবর্তনসহ বিভিন্ন অক্ষমতার কারণ হতে পারে। প্রায় ২.৩ মিলিয়ন অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে ২৫ টি গবেষণার একটি দেখা গেছে, স্থূলতা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়েছে ৬৪ শতাংশ।

৪. সম্প্রতি ভারতের কিংবদন্তী শিল্পী বাপ্পি লাহিড়ী স্লিপ অ্যাপনিয়া নামক রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। স্লিপ অ্যাপনিয়া এমন একটি ব্যাধি যেখানে কেউ ঘুমের সময় মুহূর্তেই শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যেতে পারেন।

যারা অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতার সঙ্গে বসবাস করেন তাদের স্লিপ অ্যাপনিয়া হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। এটি ঘাড়ের চারপাশে বেশি চর্বি জমা হওয়ার কারণে ও শ্বাসনালি সঙ্কুচিত হওয়ার কারণে ঘটে। ফলে ঘুমের মধ্যে স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস বাঁধাগ্রস্ত হয়।

৫. শরীরে অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত টিস্যুর জন্য বেশি অক্সিজেন ও পুষ্টির প্রয়োজন হয়। ফলে শরীরের চারপাশে রক্ত পাম্প করার জন্য হৃদযন্ত্রকে আরো পরিশ্রম করতে হয়। রক্ত সঞ্চালনের পরিমাণ বাড়তেই ধমনীর দেওয়ালে অতিরিক্ত চাপ পড়ে। এই অতিরিক্ত চাপকে উচ্চ রক্তচাপ বলা হয়। সময়ের সাথে সাথে উচ্চ রক্তচাপ হৃদপিণ্ড ও ধমনীর ক্ষতি করে।

৬. স্থূলতা ফ্যাটি লিভারের অন্যতম এক কারণ। অতিরিক্ত ওজনে যারা ভুগছেন তাদের মধ্যে নন অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ দেখা দেয়। লিভারে অতিরিক্ত চর্বি জমা হলে এটি ঘটে। অতিরিক্ত চর্বি যকৃতের ক্ষতি করে।

এর ফলে হতে পারে লিভার সিরোসিসও। ফ্যাটি লিভার রোগের সাধারণত কোনো উপসর্গ থাকে না। তবে এটি শেষ পর্যন্ত লিভার ফেইলিওরের কারণ হতে পারে। এ সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় হলো ওজন কমানো, ব্যায়াম করা ও অ্যালকোহল এড়ানো।

৭. পিত্তথলির নানা সমস্যায় নারী-পুরুষ উভয়ই ভোগেন। পিত্তথলি হজমপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকে। পিত্ত চর্বি হজম করতে সাহায্য করে। স্থূলতার কারণে পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। পিত্ত জমা হয়ে শক্ত হয়ে গেলে পিত্তথলিতে পাথর হয়।

এক্ষেত্রে পিত্তথলি সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। পিত্তথলির পাথর যন্ত্রণাদায়ক হয়। ওই পাথর বের করতে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে। উচ্চ ফাইবার ও স্বাস্থ্যকর চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়ার মাধ্যমে পিত্তথলির পাথর প্রতিরোধ করা যায়।

৮. স্থূলতা হতে পারে ক্যানসারের কারণ। স্থূলতা স্তন, কোলন, গলব্লাডার, অগ্ন্যাশয়, কিডনি ও প্রোস্টেট ক্যানসারের পাশাপাশি জরায়ু, অ্যান্ডোমেট্রিয়াম ও ডিম্বাশয়ের ক্যানসারসহ বেশ কিছু ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।

৯. গর্ভাবস্থার জটিলতা সৃষ্টি করে স্থূলতা। এক্ষেত্রে গর্ভবতী নারীদের ইনসুলিন প্রতিরোধ, উচ্চ রক্তে শর্করা ও উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। যা গর্ভাবস্থা ও প্রসবের সময় জটিলতা বাড়ায়। যেমন-

১. গর্ভাবস্থার ডায়াবেটিস
২. প্রি ক্ল্যাম্পসিয়া
৩. সিজারিয়ান ডেলিভারি প্রয়োজন হয় (সি-সেকশন)
৪. রক্ত জমাট
৫. প্রসবের পর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি রক্তপাত
৬. সময়ের পূর্বে জন্ম
৭. গর্ভপাত
৮. মৃত সন্তান প্রসব
৯. মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডের ত্রুটি ইত্যাদি।



স্থূলতা প্রতিরোধে করণীয়

ডায়েট ও ব্যায়ামের সংমিশ্রণেই শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমানো সম্ভব। এজন্য তাড়াহুড়ো করবেন না বরং সময় নিয়ে ওজন কমাতে হবে। এজন্য জীবনধারায় কঠোর পরিবর্তন আনতে হবে। দৈনিক আধা ঘণ্টা হাঁটুন। সপ্তাহে অন্তত ১৬০ মিনিট মাঝারি অ্যারোবিক করুন।

অভ্যস্ত হয়ে গেলে সপ্তাহে ৩০০ মিনিট পর্যন্ত বাড়ান শরীরচর্চা। সপ্তাহে অন্তত দুবার আপনার রুটিনে পুশআপ বা সিটআপের মতো ব্যায়ামগুলোও করুন। এর পাশাপাপাশি কয়েকটি বিষয় মেনে চলুন-

১. আপনার অর্ধেক প্লেট সবজি দিয়ে পূরণ করুন।
২. অপরিশোধিত শস্য যেমন- সাদা রুটি, পাস্তা, ভাতের বদলে গমের রুটি, বাদামি চাল ও ওটমিলের মতো গোটা শস্য দিয়ে প্রতিস্থাপন করুন।
৩. চর্বিহীন মুরগির মাংস, সামুদ্রিক খাবার, মটরশুটি ও সয়া জাতীয় প্রোটিনের উৎস রাখুন।
৪. ভাজা খাবার, ফাস্ট ফুড ও চিনিযুক্ত স্ন্যাকস বাদ দিন।
৫. চিনিযুক্ত পানীয় এড়িয়ে চলুন যেমন- কোমল পানীয় ও জুস।
৬. অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন।

আজ বিশ্ব স্থূলতা দিবস। বিশ্বব্যাপী স্থূলতা সংকট নির্মূলে সচেতনতা বাড়াতে এই দিবস পালিত হয়। এর আগে ১১ অক্টোবরকে স্থূলতা দিবস হিসেবে পালিত হতো। তবে ২০২০ সাল থেকে ৪ মার্চ পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব স্থূলতা দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য হলো ‘প্রত্যেকেরই কাজ করতে হবে’।

২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্ব স্থূলতা দিবস পালিত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ল্যানসেট কমিশন অন ওবেসিটির ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় ওয়ার্ল্ড ওবেসিটি ফেডারেশন দিবসটির আয়োজন করে আসছে।

যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন। এবং আমাদের সাথে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে।

এগুলো দেখুন

পেটে গ্যাসের সমস্যায় করণীয় কি? পেটের গ্যাস দূর করার উপায়!

পেটে গ্যাসের সমস্যায় করণীয় কি? পেটের গ্যাস দূর করার উপায়!

আসসালামুয়ালাইকুম অনেক রোগীই আমাদের কাছে আসেন পেটের সমস্যা নিয়ে পেট ফেঁপে থাকে ফুলে থাকে পেটে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *