বিমা কাকে বলে? বিমার অর্থনৈতিক গুরুত্ব এবং ইতিহাস কী?

জেনে নিন বিমা কাকে বলে বিমার অর্থনৈতিক গুরুত্ব এবং ইতিহাস কী? সম্পর্কে। আসুন আজকে এ সম্পর্কে আলোচনা করে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক। ঝুঁকি এবং অনিশ্চয়তা সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান। মানব জীবনের মতো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেও ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা বিরাজমান। পণ্য বা সেবা উৎপাদন থেকে শুরু করে তা ভোক্তার নিকট পৌঁছানো পর্যন্ত ঝুঁকি বিদ্যমান। এই ঝুঁকির পরিমাণ কমানোর ক্ষেত্রে বিমা (insurance) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, এর ফলে দিন দিন বিমার পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিমা হলো অনিশ্চিত ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর জন্য ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার একটি অংশ।



বিমা কাকে বলে বিমার অর্থনৈতিক গুরুত্ব এবং ইতিহাস কী?

বিমার সংজ্ঞা

‘বিমা’ একটি ফারসি শব্দ। বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ‘আধুনিক বাংলা ভাষার অভিধান’ অনুসারে বিমা শব্দের অর্থ হলো- অগ্রিম চাঁদা প্রদানের বিনিময়ে কোনও সম্পদ ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে বা হারিয়ে গেলে শর্তসাপেক্ষে আর্থিক ক্ষতিপূরণের চুক্তি। বিমা শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো insurance (ইন্স্যুরেন্স)। বাংলা একাডেমি প্রদত্ত বিমার এই অর্থকেও একটি স্পষ্ট সংজ্ঞা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। (অভিধান অনুসারে বহুল প্রচলিত ‘বীমা’ ভুল বানানের শব্দ; এটি বিদেশি শব্দ হওয়ায় ঈ-কার দিয়ে বীমা না লিখে ই-কার দিয়ে ‘বিমা’ লিখতে হবে।)

বিমা হলো অর্থের নির্দিষ্ট পরিমাণ বিনিময়ে জীবন, সম্পদ বা মালামালের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির ন্যায়সঙ্গত ও নির্দিষ্ট ঝুঁকির স্থানান্তর, যার মাধ্যমে বিমা প্রতিষ্ঠান অর্থের বিনিময়ে মক্কেলের আংশিক বা সমস্ত সম্ভাব্য ঝুঁকি গ্রহণ করে থাকে। অধ্যাপক আই. আর. টেইলর (I. R. Taylor) বলেছেন, “বিমা চুক্তি হলো প্রিমিয়াম পরিশোধের প্রতিদানে একপক্ষ কর্তৃক অপর পক্ষের সম্ভাব্য ক্ষতির ঝুঁকি গ্রহণের সম্মতি।” অধ্যাপক মার্ক গ্রিনির মতে, “বিমা হলো একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান যা ব্যক্তি এবং সমাজ উভয়কে সার্বিক ক্ষতির ঝুঁকি হ্রাসে সহায়তা করে।”

অতএব এটি বলা যায় যে, বিমা হলো দুটি পক্ষের মধ্যে একটি চুক্তি যার এক পক্ষ তার সম্ভাব্য ঝুঁকি গ্রহণ করার জন্য অন্য পক্ষকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করে এবং অপর পক্ষ উক্ত অর্থের বিনিময়ে ঝুঁকি গ্রহণ করে।

বিমা মানেই অন্যের ঝুঁকি নিজের ঘাড়ে নেয়া। ঝুঁকির ভার গ্রহণ করাই হলো বিমা ব্যবসার মূল বিষয়। বিমার গুরুত্ববিমার মাধ্যমে মানুষ ব্যক্তিক ও ব্যবসায়িক ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে। অন্যের ঝুঁকি নিজের ঘাড়ে নিয়ে বিমা অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ব্যবসায়ের নানা লেনদেনের সাথে বিমা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।

বিমার অর্থনৈতিক গুরুত্ব

অর্থনৈতিক দিক বিচারে বিমার প্রধান ৪ টি গুরুত্ব আছে। বিমার অর্থনৈতিক গুরুত্ব নিচে উল্লেখ করা হলো-

ব্যক্তি পর্যায়ে বিমার ভূমিকা

পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যু বা যেকোনো দুর্ঘটনার কারণে একটি পরিবার আর্থিক সংকটে পড়ে। বিমা ব্যবস্থা এরূপ ক্ষেত্রে মানুষকে আর্থিক সংকট থেকে মুক্ত করতে পারে। জীবন-বিমা, দুর্ঘটনা-বিমা ও স্বাস্থ্য-বিমা ইত্যাদি ব্যক্তি বিমার আওতাভুক্ত। বিমার মাধ্যমে বিমাগ্রহণকারীর অকাল বা পরিণত মৃত্যুতে তার উত্তরাধীকারী আর্থিক সুবিধা পায়। অগ্নি-বিমা, নৌ-বিমা, দুর্ঘটনা বিমা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও দুর্ঘটনাজনিত কারণে বিমা গ্রহীতা আর্থিক ক্ষতিপূরণ পায়।

ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে বিমার গুরুত্ব

ব্যবসায়ে ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা বিদ্যমান। পণ্যের বাজারদর কমে যাওয়া, পণ্য উৎপাদন বা সরবরাহের সময় দুর্ঘটনা ঘটা, গুদামে আগুন লাগা ইত্যাদি কারণে ঝুঁকির সৃষ্টি হয়। বিমার মাধ্যমে ঝুঁকি বা অনিশ্চয়তা হ্রাস করা যায়। ব্যবসায়ে বিমার প্রচলন সবচেয়ে বেশি। ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা দূর করার মাধ্যমে বিমা ব্যবসা-বাণিজ্যে গতিশীলতা বজায় রাখে। নৌ-বিমা, অগ্নি-বিমা, দুর্ঘটনা-বিমা, রপ্তানি-বিমা ইত্যাদি ব্যবসায়ের গতি সচল রাখে।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিমার গুরুত্ব

বিমা কোম্পানি সঞ্চিত প্রিমিয়াম লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করে। বিমা কোম্পানি ব্যক্তি ও সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষয়-ক্ষতির ঝুঁকি বহন করে। ফলে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবহনসহ সকল খাত বিমার আওতায় আসার কারণে ঝুঁকিমুক্ত একটি পরিবেশ বিরাজ করে।

সামাজিক ক্ষেত্রে বিমার ভূমিকা

বিমা কোম্পানি জীবন বিমা, সাধারণ বিমা ও অগ্নি বিমার মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করে। বিমা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করে এবং প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দেয়ার মাধ্যমে বাণিজ্যিক কার্যক্রমকে উৎসাহিত করে তোলে। বিমা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আনার ক্ষেত্রে অবদান রাখে। অতিরিক্ত বিনিয়োগের কারণে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এবং দেশের বেকারত্ব হ্রাস পায়।

বিমা কাকে বলে বিমার অর্থনৈতিক গুরুত্ব এবং ইতিহাস কী?

বিমার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এবং বাংলাদেশে বিমার অবস্থা

বিমার প্রচলন শুরু কবে?

বিমার উৎপত্তি সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে বিশেষজ্ঞরা বা গবেষকরা মনে করেন, ভূমধ্যসাগরের উত্তর অঞ্চলে, ইতালির জেনোয়া বন্দরকে কেন্দ্র করে ইউরোপীয় কয়েকটি দেশে ৪র্থ শতাব্দীতে বিমা ব্যবসায়ের প্রচলন শুরু হয়েছিল। পরে ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের ফলে ব্যবসায়ের পাশাপাশি বিমারও সম্প্রসারণ ঘটে। এ সময়ে ইউরোপের পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ঝুুঁকি মোকাবেলার জন্য বিমাকে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছিল। এ সময় বিমা সমবায়ের মাধ্যমে পরিচালিত হত। বিমা কোম্পানিগুলোর উদ্ভব তখনো হয়নি।

সর্বপ্রথম বিমা

বিমার আনুমানিক ইতিহাস থেকে জানা যায়, পৃথিবীতে যে বিমাটি সর্ব প্রথম শুরু হয় তা ছিল নৌবিমা (Marine Insurance)। ১৬৬৬ সালে লন্ডন এবং ১৮৬১ সালে টালি এস্টেটের অগ্নিকাণ্ডের ফলে প্রথমবারের মতো ব্রিটেনে অগ্নিবিমা (Fire Insurance) শুরু হয় ১৮৬৫ সালে। এরপর ১৮৯৬ সালে “Hand in Hand” নামক জীবন বিমার (Life Insurance) উদ্ভব ঘটে। এটিও শুরু হয়েছিল ইংল্যান্ডে। ইউরোপিয়রা উপনিবেশ (Colony) স্থাপনের মাধ্যমে সাম্রাজ্য বাড়াতে থাকে। এর ফলে বিমা ব্যবস্থা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

উপমহাদেশে বীমার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ

ভারতীয় উপমহাদেশে বিমা ব্যবসায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। এ উপমহাদেশে ১৮১৮ সালে ইউরোপিয়রা কলকাতায় (Kolkata/Calcutta) ‘The Oriental Life Insurance Company’ নামে একটি জীবন বিমা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিমা ব্যবসা শুরু করে। পরে ১৯২৮ সালে ‘দ্য ইন্ডিয়ান ইন্সুইরেন্স কোম্পানি অ্যাক্ট, ১৯২৮ (The Indian Insurance Company Act, 1928) নামে একটি বিমা আইন পাশ করা হয়। এ আইনটি ১৯৩৮ সালে সংশোধিত, পরিমার্জিত ও সংযোজিত হয়ে ঘোষিত হয়।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর ‘ভারত’ ও ‘পাকিস্তান’ নামক ২ টি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ভারত বিভাগের পর ১৯৫৪ ও ১৯৫৮ সালে বিমা আইনে কিছু পরিবর্তন করা হয়। ১৯৫৭ সালে ভারতে বিমা ব্যবসা জাতীয়করণ করা হয়। কিন্তু পাকিস্তানে বিমা ব্যবসায় ব্যক্তি মালিকানাধীনেই থেকে যায়।



বাংলাদেশে বিমা (Insurance in Bangladesh)

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ ‘Bangladesh Insurance (Emergency Provision) Order, 1972’ জারি করা হয়। এতে ১৯৩৮ সালের বিমা আইনটি বাংলাদেশের বিমা আইন বলে বিবেচিত হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয় এবং ৭৫টি বিমা প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করে প্রথমে ৫টি সংস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

সংস্থাগুলো হলো- ১. বাংলাদেশ জাতীয় বিমা কর্পোরেশন, ২. কর্ণফুলী বিমা কর্পোরেশন, ৩. তিস্তা বিমা কর্পোরেশন, ৪. সুরমা জীবন বিমা কর্পোরেশন এবং ৫. রূপসা জীবন বিমা কর্পোরেশন। এরপর আরো পরিবর্তন আনা হয়। ১৯৭৩ সালের ১৪ মে বিমা কর্পোরেশন অধ্যাদেশ (Insurance Corporation Ordinance, 1973) ঘোষণার মধ্য দিয়ে ৫টি বিমা সংস্থাকে ২টি সংস্থার অধীনে আনা হয়। এ ২ টি সংস্থা হলো- ১. জীবন বিমা কর্পোরেশন ও ২. সাধারণ বিমা কর্পোরেশন।

১৯৮৩ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা কর্পোরেশনের পাশাপাশি বেসরকারীভাবে বিমা ব্যবসার অনুমতি দেয়া হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচুর বেসরকারী বিমা কোম্পানি চালু আছে। ইতোমধ্যে দেশে বিমা ব্যবসা বেশ জনপ্রিয় ও লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে।

যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন। এবং আমাদের সাথে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে।

এগুলো দেখুন

ব্যাংক কাকে বলে বিস্তারিত জেনে নিন

ব্যাংক কাকে বলে বিস্তারিত জেনে নিন

ব্যাংক কাকে বলে বিস্তারিত জেনে নিন । আসুন এ সম্পর্কে আজকে আলোচনা করে বিস্তারিত জেনে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *