আশির দশকে বরিশাল ভ্রমণ

কেমন ছিল আশির দশকে বরিশাল ভ্রমণ
কেমন ছিল চল্লিশ বছর আগের বরিশাল শহর, থাকা-খাওয়ার জায়গা, বিভিন্ন স্থানে যাওয়া-আসার খরচা। অস্ট্রেলিয়ান পর্যটক ও লেখক জন মারি আশির দশকে বাংলাদেশ ঘুরতে এসে দেশের বিভিন্ন স্থানের টুকিটাকি লিপিবদ্ধ করেন আর থেকে ১৯৮৫ সালে Bangladesh, a travel survival kit নামে একটি বই বের করেন। সেসময়কার বরিশাল সম্পর্কে অনেক ইন্টারেস্টিং তথ্য রয়েছে এই বইয়ে। অনেক তথ্য হয়তো বাদ পড়ে গেছে। কেমন ছিল আশির দশকে বরিশাল ভ্রমণ, বইটি লেখা হয়েছে বিদেশীদের কথা মাথায় রেখে, সেভাবেই প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সাজানো হয়েছে। পাঠকদের জন্য অনুবাদ করে BARISHAL – 250 years History in Photographs & Stories  গ্রুফে পোস্ট করেন এডমিন Muhammad Wahidur Rahman।

আশির দশকের বরিশাল ভ্রমন সম্পর্কের লেখাটি দূর্বা টিভির পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো। বরিশাল তখনো খুলনা বিভাগের অন্তর্গত একটি জেলা শহর। মারির চোখে বরিশাল “a port city largely isolated from the rest of Bangladesh. It’s quite a large place, with a pleasant raj-period central area.”
বরিশাল খ্রিস্টান মিশনারিদের ধর্মপ্রচারের কেন্দ্রস্থল ছিল, এবং শহরে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গীর্জা রয়েছে – অ্যাংলিকান এবং রোমান ক্যাথলিক গীর্জা দুটিই সদর রোডের কাছে।

সেসময়ে পুরাতন বাসস্ট্যান্ড ছিল নতুন বাজার। শহরতলী এই এলাকায় রয়েছে বৃক্ষশোভিত রামকৃষ্ণ মিশন আর একটি বড় হিন্দু মন্দির। শহরের মধ্যে আরও কিছু পুরানো মন্দির চোখে পড়েছে, এর মধ্যে চকবাজারে কৃষ্ণ মন্দির ও সদর রোডের শেষ প্রান্তে অস্থায়ী জগন্নাথ মন্দির।
এই জেলায় দুইটি মুঘলপূর্ব মধ্যযুগীয় মসজিদ রয়েছে, একটি গৌরনদীর কসবা গ্রামে, নয়টি গম্বজ সম্বলিত, আরেকটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট পটুয়াখালীর কাছে অবস্থিত, ১৪৬৪ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত। কেমন ছিল আশির দশকে বরিশাল ভ্রমণ

বাকেরগঞ্জ ও পটুয়াখালীতে আপাতদৃষ্টিতে কিছু নতুন বৌদ্ধ মন্দির রয়েছে এবং মাধবপাশা, গৈলা, বাটাজোর, ও বানারীপাড়া গ্রামে কিছু মধ্যযুগীয় হিন্দু মন্দির রয়েছে। বরিশালের সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে দৃশ্যত কিছু চমৎকার সমুদ্র সৈকত রয়েছে। লঞ্চে কুয়াকাটা যেতে সময় লাগে নয় ঘণ্টা। বরিশাল থেকে মাত্র ১০কিলোমিটার দূরে মাধবপাশা দিঘিটি একটি পাখির অভয়ারণ্য।

থাকার ব্যবস্থা

বরিশাল শহরে মোটামুটি মানের হোটেল অভাব নেই, তবে একটু ভাল মানের হোটেল পাওয়া দুরূহ। ফজলুল হক এভিনিউ মোড়ে বাহাদুর বোর্ডিং নামে একটি আবাসিক হোটেল রয়েছে, সিঙ্গেল/ডাবল রুম এটাচড বাথরুমসহ ৪০/৬০টাকা ভাড়া/প্রতিদিন। হোটেল চন্দ্রদ্বীপ নামের একটি হোটেল আছে, মোটামুটি রিজনেবল। টেলিফোন নং- ৩৮৮১, ডেস্কের লোকগুলো তেমন কাজের না। সিঙ্গেল/ডাবল রুম এটাচড বাথরুমসহ ভাড়া যথাক্রমে ৪০/৭০টাকা প্রতিদিন।

লাইন রোডে হোটেল নুপুর (টেলি- ৩৩৮৮) এর মান ভাল, তবে ভাড়া অতিরিক্ত। ১০০/১৭০টাকা এটাচড বাথরুম সহ সিংগেল/ডাবল রুমের জন্য। সদর রোডস্থ হোটেল লাক্সারি তুলনামূলক ভাবে উত্তম, ডাবল রুমগুলো বেশ বড়, এটাচড বাথরুম আছে, ভাড়া ১১০টাকা। চেকআউট এর সময় চেকইন সময়ের ২৪ ঘন্টা পর যে কেনো সময়ে। অসময়ে জাহাজ ধরতে হয় কিছুক্ষেত্রে, সেহিসাবে এই ব্যবস্থা বেশ সুবিধাজনক।

শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে একদম পশ্চিমে, মেডিকেল কলেজ ছাড়িয়ে অরিয়েন্টাল ইন্সটিটিউট, অনেক জায়গা জুড়ে দারুন নিরিবিলি পরিবেশ। এখানের রুমগুলো মূলত ধর্মীয় উপাসনার জন্য ব্যবহৃত হয়, যদি রুম খালি থাকে, সেখানেও থাকার ব্যবস্থা হতে পারে। পরিচালককে আগে জানাতে হবে।
সদর রোডস্থ ক্যাথলিক গেস্ট হাউজে মেহমানদের জন্য দুইটি রুমের ব্যবস্থা আছে, প্রতি বেডের জন্য ভাড়া ২০টাকা। জার্মান ফাদারের সাথে কথা বলতে হবে। গাঢ় লাল রঙের পুরানো বিল্ডিং অক্সফোর্ড মিশন অ্যাংলিকান চার্চ, এখানে ডগলাস বোর্ডিংয়েও থাকার সুযোগ রয়েছে।

খাওয়ার ব্যবস্থা

বরিশাল শহরে উল্লেখযোগ্য দুইটি চাইনিজ রেস্টুরেন্ট রয়েছে, একটি গোল্ডেন টাওয়ার (লম্বা, অপ্রশস্থ হলুদ বিল্ডিং), ফজলুল হক এভিনিউ এ বাহাদুর বোর্ডিং এর ঠিক পাশেই, আকারে ছোট তবে বন্ধুসুলভ পরিবেশ। আরেকটি হোটেল সাউথ কিং, নদীর কাছাকাছি। শহরের কেন্দ্রস্থলে ও ফেরীঘাট এলাকায় আরো বেশ কিছু ভাল লোকাল খাবার রেস্তোরা রয়েছে। কয়েকটি চায়ের দোকানে দারুন লাল চা পাওয়া যায়, দুধ বিহীন এলাচ চা।

আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা কেমন ছিল আশির দশকে বরিশাল ভ্রমণ

বরিশালের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা সুবিধাজনক নয়, বেশ দীর্ঘ ও ঘুরপথ সম্বলিত। এখানে যশোর বা গোয়ালন্দ ঘাট যেতে আরিচা ফেরী হয়ে যেতে হয়। ঢাকার সরাসরি বাস রয়েছে, কিন্তু দাবিকৃত আট ঘণ্টায় সেই যাত্রা করাটা হবে দুঃস্বপ্নের মতো। ফরিদপুরের দক্ষিনে ভাঙ্গাতে একটি অনিয়মিত ধীরগতির ট্রেন চলাচল রয়েছে,, যা রাজবাড়ী পর্যন্ত যায়, কুষ্টিয়া যেতে এই রুট নিতে পারেন। সব মিলিয়ে বরিশাল আসতে কিংবা কোথাও যেতে নৌপথই অধিক কার্যকরী ও সুবিধাজনক।

বাস- মূল বাসস্ট্যান্ড শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, রিক্সায় যেতে ৬টাকা ভাড়া। লঞ্চঘাটের কাছে আরেকটি ছোট বাসস্ট্যান্ড আছে, বেশ কিছু রুটের বাস ছাড়ে এখান থেকে। ঢাকার সরাসরি এক্সপ্রেস বাস আছে, আট ঘন্টার জার্নি, ভাড়া গুনতে হবে ৫০টাকা। বাসগুলো ভোর ৫.৩০ থেকে ৭.৩০ টার মধ্যে ছাড়ে। ফরিদপুর হয়ে লোকাল বাসে যাওয়ার অপশন রয়েছে, কিন্তু ঝক্কি বেশ। ৫ ঘন্টার জার্নি, তিনবার বাস বদলাতে হয়, আর মাঝে ফেরী তো আছেই।

একটি নতুন ব্রিজ তৈরি হচ্ছে, এতে দুর্ভোগ কিছুটা লাঘবে হবে। বরিশাল-ফরিদপুরে জনপ্রতি ভাড়া ৩৫টাকা। যশোর থেকে বরিশাল প্রতিদিন তিনটি করে বাস ছেড়ে আসতো, সকাল ৮টা, ৯.৩০টা ও রাত ৯.৩০টায়। ভাড়া-৭০টাকা। বরিশাল থেকে রাতে বেনাপোলগামী বাস রয়েছে, ৮ ঘন্টার জার্নি, ভাড়া-৮০টাকা। নোথালী (নথুল্লাবাদ?) বাসস্ট্যান্ড থেকে ছাড়ে।

খুলনা থেকে বরিশাল, বেশ কিছু বাস চলাচল করতো, ভাড়া ছিল ৯০টাকা জনপ্রতি। প্রায় ৭ ঘন্টার জার্নি, কখনো আরো বেশি। খুলনা শহরে স্টেশন রোডে, পার্ক হোটেল্র পাশে বরিশাল রেস্ট হাউজ নামে একটি মোটামুটি মানের আবাসিক হোটেল ছিল। সিংগেল/ডাবল বেড রুম ভাড়া-২৫/৪০টাকা।
লোকাল রুটে বরিশাল থেকে বাকেরগঞ্জ বাস ভাড়া ৩টাকা আর পটুয়াখালীর ভাড়া ১২টাকা। পটুয়াখালী থেকে বরগুনা, গলাচিপা ও খেপুপাড়ার বাস রয়েছে।

BIWTC পরিচালিত রকেট ষ্টীমার সদরঘাটের বাদামতলী ঘাট থেকে ছাড়তো। ষ্টীমারগুলোর মধ্যে পিএস গাজী ও পিএস মাসুদ, আকারে বড় ও বিলাসবহুল, অন্যদিকে পিএস টার্ন তুলনামূলক ভাবে দ্বিতীয় চয়েজে থাকবে। ষ্টীমারগুলো ঢাকা-বরিশাল-খুলনা রুটে চলতো, লম্বা জার্নি, প্রায় ২৪ ঘন্টার। ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়ার সময় বিকাল ৫.৩০টা। সপ্তাহে চারদিন, শনি, সোম, বুধ ও বৃহস্পতিবার। খুলনা থেকে ছেড়ে আসতো, শনি, সোম, বুধ ও শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায়। গোটা জার্নির ভাড়া যথাক্রমে, ফার্স্ট ক্লাস-৪৮৮টাকা, সেকেন্ড ক্লাস-২৯৬টাকা, ইন্টার ক্লাস-১১৬টাকা ও ডেক-৭২টাকা। বরিশাল-খুলনা রুটে ভাড়া ছিল যথাক্রমে- ২৩০/১৫০/৬৪/৪০টাকা। মংলায় নামলে ভাড়া ১৮০/১২০/৫০/৩০ টাকা।

বরিশাল থেকে সোম, বুধ, শুক্র ও শনিবার রাত ৯.৩০ মিনিটে চাঁদপুর হয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রকেট রয়েছে। ঢাকার ভাড়া ১ম/২য়/আন্তঃ/ডেক ক্লাসে ২৬৮/১৪২/৫৫/৩৭ টাকা। ১২ ঘন্টার জার্নি, যদিও এটি সহজেই ১৮ ঘন্টা হয়ে যেতে পারে। চাঁদপুর যেতে মোটামুটি আট ঘণ্টা লাগে এবং ভাড়া ১ম/২য়/আন্তঃ/ডেক ক্লাসে ১৩৭/৮৩/৩৩/২৩ টাকা।

বরিশাল থেকে চট্টগ্রামে সরকারি BIWTC জাহাজ মঙ্গল ও শুক্রবার রাত ৮.৩০ মিনিটে চলতো এবং ভাড়া যথাক্রমে ৩২৭/২১৭/৮৫/৫৭টাকা। টার্মিনালটি ছিল সদরঘাটের পশ্চিম প্রান্তে, চট্টগ্রাম থেকে সী ট্রাকগুলি সোম ও বৃহস্পতিবার সকাল ৯ টায় বরিশালের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসতো। মোট ২০ ঘন্টার দীর্ঘ জার্নি।

বেসরকারি লঞ্চগুলো মালিক সমিতির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। বরিশালগামী লঞ্চগুলো- সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে ছাড়তো, ১২ঘন্টার জার্নি, ভাড়া- ফাস্ট ক্লাসে ১৬০টাকা ও ডেক জনপ্রতি ৪৮টাকা। ভোলাগামী দুইটি লঞ্চ, একটি সন্ধ্যা ৭টায় ও আরেকটি ৭.৩০এ। ভাড়া ফার্স্ট ক্লাস-১৫০টাকা ও ডেক ২০টাকা। পটুয়াখালীগামী দুইটি লঞ্চেরও ভাড়া একই, সন্ধ্যা ৬টা ও ৬.৩০টায় ছাড়তো। কেমন লাগলো? কমেন্ট করে জানান, আপনার মতামত। সেসময়কার যাতায়াত, হোটেল ভাড়া, হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোর বিস্তারিত। কিছু বাদ পড়লে সেটাও জানান।

যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *