উপহার চেয়ে নেওয়া কি জায়েজ?

জেনে নিন উপহার চেয়ে নেওয়া কি জায়েজ? আসুন আজকে এ সম্পর্কে আলোচনা করে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক। অনেকেই বন্ধু-বান্ধব বা পরিচিত জনের কাছে বই অথবা বিভিন্ন জিনিস উপহার চায়। কারও কাছে উপহার সামগ্রী বা টাকা-পয়সা চাওয়া কি ভিক্ষাবৃত্তির মতো? হাদিসে বিনা প্রয়োজনে ভিক্ষাবৃত্তির শাস্তির কথা এসেছে। তাই কেউ যদি দরকার ছাড়া কারও কাছে কোনও উপহার সামগ্রী বা টাকা-পয়সা চায়; এটাও কি ওই হাদিসের অন্তর্ভূক্ত হবে?



ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, বাবা-মা, নিকটাত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব পরস্পর উপহার সামগ্রী চাইবে বা বিনিময় করবে এটা স্বাভাবিক বিষয়। পরিচিত জনের কাছে উপহার সামগ্রী, বই-পত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ কিংবা টাকা-পয়সা চাওয়া যায়। এটা দোষণীয় নয়। তারপরও ইসলাম দরকার ছাড়া কারও কাছে কোনো জিনিস চাওয়াকে অনুৎসাহিত করেছে। হাদিসের একাধিক বর্ণনা থেকে তা সুস্পষ্ট।

উপহার চেয়ে নেওয়া কি জায়েজ?

ইসলাম মানুষকে অন্যের কাছে কোনও কিছু চাওয়ার ব্যাপারে অনুৎসাহিত করে। নিজেদের উন্নত চরিত্র ও সম্মানজনক আত্মমর্যাদার শিক্ষা দেয়। অন্যের সম্পদের দিকে লোভাতুর দৃষ্টি দিতে নিষেধ করে। একান্ত দরকার ছাড়া কারা কাছে কোনো কিছু চাওয়াকেও নিরুৎসাহিত করে। হাদিসের একাধিক বর্ণনায় এসেছে-

১. হজরত আবু যার রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (একদিন তাকে) ডেকে এনে শর্তারোপ করে বললেন-

أَنْ لَا تَسْأَلَ النَّاسَ شَيْئًا قُلْتُ: نَعَمْ. قَالَ: وَلَا سَوْطَكَ إِنْ سَقَطَ مِنْكَ حَتَّى تنزل إِلَيْهِ فتأخذه

‘তুমি কারও কাছে কোনও কিছুর জন্য হাত পাতবে না। আমি বললাম, ‘জ্বি-হ্যাঁ’। তারপর তিনি বললেন, এমনকি তোমার হাতের লাঠিটাও যদি পড়ে যায় তবুও কাউকে তা উঠিয়ে দিতে বলবে না। বরং তুমি নিজে নেমে তা উঠিয়ে নেবে।’ (মুসনাদে আহমাদ, আত-তারগিব)

২. হজরত সাওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন-

من يتقبَّلُ لي بواحدةٍ وأتقبَّلُ لَهُ بالجنَّةِ قلتُ أنا قالَ لا تسألِ النَّاسَ شيئًا قالَ فَكانَ ثَوبانُ يقعُ سوطُهُ وَهوَ راكبٌ فلا يقولُ لأحدٍ ناوِلنيهِ حتَّى ينزلَ فيأخذَهُ

‘কে রয়েছে যে, আমার একটি কথা কবুল করবে? আমি তার জান্নাতের জিম্মাদার হবো। আমি (সাওবান) বললাম, ‘আমি’। তিনি বললেন- ‘তুমি মানুষের কাছে কোনো কিছু চাইবে না।’

বর্ণনাকারী বলেন, সাওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু সাওয়ারিতে আরোহী থাকা অবস্থায় যদি তার হাতের ছড়িটা নিচে পড়ে যেতো তাহলে তিনি কাউকে বলতেন না যে, এটি আমাকে তুলে দাও। বরং তিনি বাহন থেকে নেমে তা তুলে নিতেন।’ (নাসাঈ, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ)

উল্লেখিত হাদিস ২ টি থেকে আত্মমর্যাদার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে এসেছে। এ হাদিস ২ টিতে অন্যের কাছে কোনও কিছু চাওয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তাই কারও কাছে কোনও কিছু চাওয়া এমনকি বিনা প্রয়োজনে কোনও কিছু চাওয়া ঠিক নয়।

তাছাড়া কোনো ব্যক্তি দরকার কিংবা বিনা প্রয়োজনে যদি কারও কাছে কিছু চায় তবে তাকে মানুষ অপছন্দ করতে শুরু করে। এ সম্পর্কে হাদিসে একটি বর্ণনা এভাবে এসেছে-

৩. হজরত আবুল আব্বাস সাহল ইবনে সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, এক ব্যক্তি নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললেন- ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনি আমাকে একটা বিষয় বলে দিন যা করলে আল্লাহ আমাকে ভালোবাসবেন এবং মানুষও ভালোবাসবে। তিনি বললেন-

ازْهَدْ في الدُّنْيَا يُحِبّك اللهُ، وَازْهَدْ فِيمَا عِنْدَ النَّاسِ يُحِبّك النَّاسُ

‘দুনিয়া থেকে লালসামুক্ত হও তাহলে আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন। আর মানুষের ধন-সম্পদ থেকে লালসামুক্ত হও তাহলে তারাও তোমাকে ভালোবাসবে।’ (ইবনে মাজাহ)

বন্ধু-বান্ধব, প্রিয়জনের কাছে চাওয়া

তবে সামর্থ্যবান একান্ত কাছের মানুষ, প্রিয়জন, বন্ধু-বান্ধব বা নিকটাত্মীয়দের কাছে সুসম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার দিক থেকে কখনও কোনও উপহার চাওয়া হলে তা হাদিসে নিষিদ্ধ ‘ভিক্ষা বৃত্তি’র অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে না।

কারণ ইসলামে ‘ভিক্ষা বৃত্তি’ জীবন-জীবিকার একটি পেশা এবং অর্থ-সম্পদ বৃদ্ধির একটি মাধ্যম হিসেবে মানুষের কাছে বিবেচিত বিধায় জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কারো কাছে হাত পাতা নিষিদ্ধ। এ সম্পর্কে হাদিসে শাস্তির কথা ওঠে এসেছে।

১. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

مَنْ سَأَلَ النَّاسَ أَمْوَالَهُمْ تَكَثُّرًا فَإِنَّمَا يَسْأَلُ جَمْرًا فَلْيَسْتَقِلَّ أَوْ لِيَسْتَكْثِرْ

‘যে ব্যক্তি সম্পদ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে মানুষের কাছে অর্থ চায়; সে মূলত (জাহান্নামের) জ্বলন্ত অঙ্গার চায়। অতএব সে কম-বেশি যা ইচ্ছা চেয়ে বেড়াক।’ (মুসলিম)

২. হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

مَا يَزَالُ الرَّجُلُ يَسْأَلُ النَّاسَ حَتّى يَأْتِيَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لَيْسَ فِي وَجْهِه مُزْعَةُ لَحْمٍ

‘যে ব্যক্তি সব সময় মানুষের কাছে ভিক্ষা করতে থাকে কেয়ামতের দিন সে এমনভাবে উঠবে যে, তার মুখমণ্ডলে গোশত থাকবে না।’ (বুখারি ও মুসলিম)

ভিক্ষাবৃত্তির চেয়ে কাজের প্রতি উৎসাহ

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কারো কাছে কোনো চাওয়ার পরিবর্তে কাজ করার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। হাদিসে পাকে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

‏ لأَنْ يَأْخُذَ أَحَدُكُمْ حَبْلَهُ فَيَأْتِيَ بِحُزْمَةِ الْحَطَبِ عَلَى ظَهْرِهِ فَيَبِيعَهَا فَيَكُفَّ اللَّهُ بِهَا وَجْهَهُ، خَيْرٌ لَهُ مِنْ أَنْ يَسْأَلَ النَّاسَ أَعْطَوْهُ أَوْ مَنَعُوهُ

‘তোমাদের মধ্যে কেউ যদি রশি নিয়ে (বন-জঙ্গলে গিয়ে কাঠ কেটে) পিঠে কাঠের বোঝা বয়ে এনে বিক্রি করে তবে আল্লাহ তাআলা তাকে (ভিক্ষাবৃত্তির অপমান থেকে) রক্ষা করেন। তাহলে তা মানুষের কাছে তার হাতপাতার চেয়ে উত্তম। (কারণ) তারা দিতেও পারে আবার নাও দিতে পারে।’ (বুখারি)

মনে রাখতে হবে

উপহার চেয়ে নেয়ার বিষয় নয় বরং একে অপরকে সম্প্রীতি ও সদ্ভাব বজায় রাখার নিদর্শন হিসেবে পরস্পরের মধ্যে উপহার বিনিময় করা উত্তম। পাস্পরিক ভালোবাসা ও সুসম্পর্ক বৃদ্ধিতে উপহার আদান-প্রদান করা ইসলামে সুন্নাতও বটে। আবার কেউ উপহার দিলে দাতাকে প্রতিদান দেয়াও সুন্নাত। হাদিসের নির্দেশনা এমনই-

১. হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেছেন-

كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقْبَلُ الْهَدِيَّةَ وَيُثِيبُ عَلَيْهَا‏.‏ لَمْ يَذْكُرْ وَكِيعٌ وَمُحَاضِرٌ عَنْ هِشَامٍ عَنْ أَبِيهِ عَنْ عَائِشَةَ‏.‏

‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদিয়া কবুল করতেন এবং তার প্রতিদানও দিতেন।’ (বুখারি)



২. হজরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

وَمَنْ أَتَى إِلَيْكُمْ مَعْرُوفًا فَكَافِئُوهُ، فَإِنْ لَمْ تَجِدُوا فَادْعُوا لَهُ، حَتَّى يَعْلَمَ أَنْ قَدْ كَافَأْتُمُوهُ‏

‘যে ব্যক্তি তোমাদের জন্য ভালো কিছু করে তোমরা তার প্রতিদান দাও। প্রতিদান দেয়ার মত কিছু না থাকলে তার জন্য দোয়া করো; যাতে সে অনুভব করতে পারে যে, তোমরা তার ভালো কাজের প্রতিদান দিয়েছো।’ (আবু দাউদ, নাসাঈ, আদাবুল মুফরাদ)

সুতরাং এ বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, কারো কাছে উপহার চেয়ে নেয়া ঠিক নয়। বরং ইসলামের রীতি অনুযায়ী পরস্পরের মধ্যে আদান-প্রদান সুন্নাত। যাতে রয়েছে ইবাদতের সাওয়াব।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে হাদিসের উপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। বিনা প্রয়োজনে কারো কাছে কোনো কিছু চাওয়া থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।

যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন। এবং আমাদের সাথে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে।

এগুলো দেখুন

সালাতুত তাসবিহ পড়ার নিয়ম

ফজরের জামাত চলা অবস্থায় সুন্নত পড়া যাবে?

জেনে নিন ফজরের জামাত চলা অবস্থায় সুন্নত পড়া যাবে? আসুন এ বিষয়ে কোরআনে কি বলা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *