ফিরোজ মাহমুদ।। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্বীয় বান্দাদের প্রতি অধিক দয়ালু ও ক্ষমাশীল। তিনি তার বান্দাদের যে কোনো উপায়ে ক্ষমা করতে ও তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করতে পছন্দ করেন। এ কারণেই আল্লাহ বান্দাদের জন্য বিভিন্ন আমলের বিনিময় অগণিত অসংখ্য পুরস্কার ঘোষণা করেন।
বিভিন্ন সময়ে আল্লাহ তাদের আমল করার সুযোগ দিয়ে তাদের নাজাতের ব্যবস্থা করেন যেমন,রমজান মাসের রোজা রাখাকে জাহান্নাম থেকে বাচার ডাল স্বরূপ বলা হয়েছে এবং আশুরার রোজা রাখলে এক বছরের গুনাহ মাপের ঘোষণা দিয়েছেন এবং আরাফার দিবসের রোজা রাখাতে পূর্বের ও পরবর্তী এক বছরের গুনাহ মাফের ঘোষণা দিয়েছেন। এভাবেই আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় বান্দাদের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ দেখিয়ে তাদের কোনো না কোনো উপায়ে জান্নাত লাভের পথকে সহজ করেছেন। যাতে বান্দাগণ আল্লাহর নৈকট্য লাভে ধন্য হন।
এ ধরনের একটি মৌসুম হল, যিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন ও তার পরবর্তী তাশরীকের দিনসমূহ। আল্লাহ তা‘আলার অশেষ মেহেরবানী যে, তিনি নেককার বান্দাদের জন্য এ মৌসুমে স্বীয় বান্দাদের জন্য নেক আমল করার সুযোগ করে দিয়েছেন এবং দিনগুলোতে যে কোনো ধরনের নেক আমল করা আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় বলে আখ্যায়িত করেছেন।
এ সুযোগটি একজন বান্দার দীর্ঘ জীবনে বারবার আসে আর যায়। সৌভাগ্যবান সে ব্যক্তি যে আল্লাহর দেওয়া সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ধন্য হতে পারে। আর দুর্ভোগ ও হতাশা তাদের জন্য এ সুযোগ পেয়েও তা কাজে লাগাতে পারেনি। নিজের ইহকাল ও পরকালের জীবনের জন্য কোনো কিছুই উপার্জন করতে পারে নি।
১. যিলহজ মাসের ১ম মাসের প্রথম দশদিন আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পরকালের পুঁজি সঞ্চয় করা যেতে পারে। এ দিনগুলো গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
“কসম ভোরবেলার। কসম দশ রাতের”।[সূরা ফাজর ১-২] ইবনে কাসীর (রাহ:)বলেন: এর দ্বারা উদ্দেশ্য যিলহজ মাসের দশ দিন।
২. আল্লাহ তা‘আলা বলেন
‘যাতে তারা তাদের কল্যাণময় স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে এবং তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু হতে যা রিজিক হিসেবে দান করেছেন তার উপর নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে।[সূরা হাজ ২৮]’
“ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন: ‘নির্দিষ্ট দিনসমূহ দ্বারা উদ্দেশ্য যিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন”। বিশিষ্ট সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন:
যিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনে নেক আমল করার মত অধিক প্রিয় আল্লাহর নিকট আর কোনো আমল নেই। তারা প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর পথে জিহাদ করাও কি তার চেয়ে প্রিয় নয়? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: না, আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। তবে ঐ ব্যক্তির কথা আলাদা যে তার জান-মাল নিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদে বের হয়ে গেল অতঃপর তার প্রাণ ও সম্পদের কিছুই ফিরে এলো না।[বুখারী]
৪. ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর নিকট কোনো দিন অধিক প্রিয় নয়, আর না তাতে আমল করা, এ দিনের তুলনায়। সুতরাং, তাতে তোমরা বেশি করে তাহলীল, তাকবীর ও তাহমীদ পাঠ কর।[তাবরানি]
৫. সাঈদ ইবনে জুবায়ের রাহিমাহুল্লাহর অভ্যাস ছিল, যিনি পূর্বে বর্ণিত ইবনে আব্বাসরে হাদিস বর্ণনা করেছেন: যখন যিলহজ মাসরে ১ম দশ দিন প্রবেশ করত, তখন তিনি খুব মুজাহাদা করতেন, যেন তার উপর তিনি শক্তি হারিয়ে ফেলবেন।[দারামি]
৬. ইবনে হাজার রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন: যিলহজ মাসের দশ দিনের ফযিলতের তাৎপর্যের ক্ষেত্রে যা স্পষ্ট, তা হচ্ছে এখানে মূল ইবাদতগুলোর সমন্বয় ঘটছে। অর্থাৎ সালাত, সিয়াম, সদকা ও হজ, যা অন্যান্য সময় আদায় করা হয় না।[ফাতহুল কাবির]
৭. উলামায়ে কেরাম বলেছেন: যিলহজ মাসরে ১ম দশদিন সর্বোত্তম দিন, আর রমযান মাসের শেষ দশ রাত, সব চেয়ে উত্তম রাত।
পবিত্র এ মাসের প্রথম দশ দিনে আমরা যে আমলগুলো করতে পারি
১.যুল্ হাজ্জের প্রথম নয়দিনে রোযা পালন করা মুসলিমের জন্য উত্তম। কারণ, নাবী কারীম (সা.) এই দিনগুলিতে নেক আমল করার জন্য সকলকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আর রোযা উত্তম আমলসমূহের অন্যতম; যা আল্লাহ পাক নিজের জন্য মনোনীত করেছেন। যেমন হাদীসে কুদসীতে বলা হয়েছে, আল্লাহ বলেন, ‘‘আদম সন্তানের প্রত্যেক কাজ তার নিজের জন্য, কিন্তু রোযা আমারই জন্য এবং আমি নিজে তার প্রতিদান দেব।’’
প্রিয় নবী (সা.)ও এই নয় দিনে রোযা পালন করতেন। তাঁর পত্নী (হাফসাহ রাঃ) বলেন, ‘‘নবী (সা.) যুল হাজ্জের নয় দিন, আশুরার দিন এবং প্রত্যেক মাসের তিন দিন; মাসের প্রথম সোমবার এবং দুই বৃহস্পতিবার রোযা রাখতেন।’’
মোট কথা, যুলহাজ্জ মাসের এই নয় দিনে রোযা রাখা মুস্তাহাব। ইমাম নববী (রহ) বলেন, ‘ঐ দিনগুলিতে রোযা রাখা পাকা মুস্তাহাব।’
যদি কেউ যুলহাজ্জের প্রথম তারীখ থেকে রোযা রাখতে সক্ষম না হয়, তাহলে অন্ততঃপক্ষে তাকে এ মাসের ৯ম তারীখে রোযা রাখতে অবশ্যই চেষ্টা করা উচিত। যেহেতু রসূল (সা.) তার গুরুত্ব ও ফযীলতের উপর উম্মতকে বিশেষভাবে অবহিত ক’রে রোযা রাখতে অনুপ্রাণিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘আরাফার দিন রোযা অতীত এক বছর ও আগামী এক বছরের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে।’’
২. তাওবা: তাওবা অর্থ ফিরে আসা বা প্রত্যাবর্তন করা। আল্লাহ তা‘আলার নাফরমানি থেকে ফিরে আসা, আল্লাহর হুকুমের পাবন্দি করার উপর দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা এবং অতীতের কৃত কর্মের উপর অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়ে তা ছেড়ে দেওয়া এবং ভবিষ্যতে আর কখনো আল্লাহর নাফরমানি না করা ও তার হুকুমের অবাধ্য না হওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প করা। এ দিন গুলোতে তাওবা করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার একটি সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে।
৩. ফরয ও নফল সালাতগুলো গুরুত্বের সাথে আদায় করা: অর্থাৎ ফরয ও ওয়াজিবসমূহ সময়-মত সুন্দর ও পরিপূর্ণভাবে আদায় করা, যেভাবে আদায় করেছেন প্রিয় নবী (সা;)। সকল ইবাদতসমূহ তার সুন্নত, মোস্তাহাব ও আদব সহকারে আদায় করা। ফরয সালাতগুলো সময় মত সম্পাদন করা, বেশি বেশি করে নফল সালাত আদায় করা।
যেহেতু এগুলোই আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার সর্বোত্তম মাধ্যম। সাওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ (সা:)কে বলতে শুনেছি: তুমি বেশি বেশি সেজদা কর, কারণ তুমি এমন যে কোনো সেজদাই কর না কেন তার কারণে আল্লাহ তোমার মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন এবং তোমার গুনাহ ক্ষমা করবেন। [মুসলিম] এটা সব সময়রে জন্য প্রযোজ্য।
নিয়মিত ফরয ও ওয়াজিবসমূহ আদায়ে যত্নবান হওয়া- অর্থাৎ, ফরয ও ওয়াজিবসমূহ সময়-মত সুন্দর ও পরিপূর্ণভাবে আদায় করা। যেভাবে আদায় করেছেন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সকল ইবাদতসমূহ তার সুন্নত, মোস্তাহাব ও আদব সহকারে আদায় করা।
৪.যারা কুরবানি দিব এবং চুল, নখ ইত্যাদি আগামী ১০ দিন না কাটলে খুব বেশি অসুবিধা নাই। তারা আজ থেকেই চুল, দাড়ি, নখ ও শরীরের অন্যান্য লোম কাটা থেকে বিরত থাকি। ঈদের দিন কুরবানি দেয়ার পর এগুলো কাটব। এতে একটি মুস্তাহাব আমল করার সওয়াব পাওয়া যাবে।
চলবে…
লেখক: ইসলামী গবেষক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব
আরো পড়ুন: রাসূল (স:) এর ঈদ যেমন ছিল
যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুণ।