জেনে নিন মুন্সিগঞ্জের যেসব স্থান ঘুরবেন এবং এসব জায়গায় গেলে কি কি দেখতে পাবেন। ইতিহাস ও ঐতিহ্য ঘেরা এক জেলা হলো মুন্সিগঞ্জ। সেখানে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান রয়েছে। যারা মুন্সিগঞ্জ ভ্রমণে যেতে চান, তারা চাইলে একদিনেই ঘুরে আসতে পারেন সেখানকার বিভিন্ন স্থান থেকে। রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ৩২ কিলোমিটার দূরে মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলা।
- আরো পড়ুন: পরিযায়ী পাখি দেখতে যাবেন যেখানে
- আরো পড়ুন: কাদিগড় জাতীয় উদ্যানে যেভাবে যাবেন
- আরো পড়ুন: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে যা আছে দেখার
মুন্সিগঞ্জের যেসব স্থান ঘুরবেন
জগদীশ চন্দ্র বসুর বসতবাড়ি
সেখানেই আছে জগদীশ চন্দ্র বসুর পৈতৃক বসতবাড়ি। যেটি এখন জগদীশ চন্দ্র বসু স্মৃতি জাদুঘর কমপ্লেক্স হিসেবে পরিচিত। প্রায় ৩০ একর আয়তনের এই বাড়িতে অসংখ্য বৃক্ষরাজির ছায়াময় প্রকৃতির মাঝে বিভিন্ন পশুপাখির ম্যুরাল, কৃত্রিম পাহাড়-ঝরনা, শান বাঁধানো পুকুর ঘাট রয়েছে।
এমনকি দর্শনার্থীদের বিশ্রামের জন্য ত্রিকোণাকৃতির ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। জগদীশ চন্দ্র বসু স্মৃতি জাদুঘরে জগদীশ চন্দ্র বসুর পোর্ট্রেট, বিভিন্ন গবেষণাপত্র, হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল প্রাপ্তিতে লেখা চিঠি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাঠানো চিঠি ও ১৭টি দুর্লভ ছবি প্রদর্শনের জন্য রাখা রয়েছে।
বাংলাদেশের প্রথম সফল বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তার সমৃদ্ধ শিক্ষা জীবনের একপর্যায়ে ১৮৮০ সালে চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়নের উদ্দেশ্যে লন্ডনে যান। তবে তিনি পদার্থ, রসায়ন ও উদ্ভিদ শাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে ১৮৮৪ সালে দেশে ফিরে আসেন।
মহান এই বিজ্ঞানী জীবিত অবস্থায় তার সব সম্পত্তি জনকল্যাণে দান করেন। ১৯২১ সালে তার জমিতে সুরুজ বালা সাহা বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে স্যার জগদীশ ইনস্টিটিউশন ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০১১ সালে জগদীশ ইনস্টিটিউশনের উদ্যোগে জগদীশ চন্দ্র বসু কমপ্লেক্স বাস্তব রূপ লাভ করে। ১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বর ভারতের ঝাড়খণ্ডের গিরিডিতে এই বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানীর জীবনাবসান ঘটে।
মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে তার আজীবন সঞ্চিত ১৭ লাখ টাকার মধ্যে ১৩ লাখ টাকা ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’কে দান করেন। ১৯৫৮ সালে জগদীশ চন্দ্রের শততম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘জেবিএনএসটিএস’ নামে একটি বৃত্তি প্রদান আরম্ভ করেন।
জগদীশ চন্দ্র যে গ্যালিলিও-নিউটনের সমকক্ষ বিজ্ঞানী তার স্বীকৃতি দিয়েছিল ১৯২৭ সালে লন্ডনের ডেইলি এক্সপ্রেস পত্রিকা। আইনস্টাইন তার সম্পর্কে বলে গেছেন, ‘জগদীশচন্দ্র যেসব অমূল্য তথ্য পৃথিবীকে উপহার দিয়েছেন তার যে কোনোটির জন্য বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করা উচিত।’
ব্যাংক অব ইংল্যান্ড তাদের ৫০ পাউন্ডের নোটে নতুন কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির মুখ যুক্ত করার জন্য নমিনেশন দিয়েছে। তাদের ওয়েবসাইটের হিসাবে গত ২৬ নভেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার নমিনেশন গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে তারা ১ লাখ ১৪ হাজার নমিনেশন প্রকাশ করে। যেখানে স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুকে সেরা তালিকায় রাখা হয়েছে। যদি নির্বাচিত হয় তাহলে ২০২০ সালে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের ৫০ পাউন্ডের নোটে দেখা যাবে বাংলার এই গর্বিত বিজ্ঞানীর নাম।
মূলত তারবিহীন প্রযুক্তিতে তিনি যে অবদান রেখেছেন সেটার কল্যাণেই আজকে আমরা ওয়াইফাই, ব্লুটুথ বা স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ খুব সহজে ব্যবহার করতে পারছি। আধুনিক রেডিওর জনক হিসেবে জি.মার্কনিকে আমরা বিবেচনা করে থাকি, ১৯০১ সালে তার আবিষ্কারের জন্য। তবে তার কয়েক বছর আগেই স্যার জগদীশচন্দ্র বসু তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদান করেন।
ভাগ্যকুলের মিষ্টি
মুন্সিগঞ্জে যাবেন অথচ বিখ্যাত ভাগ্যকুলের মিষ্টি খাবেন না, তা কি হয়! মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার ভাগ্যকুল বাজার সুস্বাদু মিষ্টি ও ঘোলের জন্য পুরো বাংলাদেশেই সুপরিচিত। আদি ও আসল স্বাদের সন্দেশ, ছানা, চমচমের মতো বিভিন্ন মিষ্টান্ন খেতে চাইলে ভাগ্যকুল এক স্বর্গীয় স্থান।
বাহারি মিষ্টির বাহার নিয়ে ভাগ্যকুলের বিভিন্ন মিষ্টান্ন ভান্ডারগুলো যেন আপ্যায়নের পসরা সাজিয়ে বসে আছে সেখানে। এদের মধ্যে গোবিন্দ মিষ্টান্ন ভান্ডার ও চিত্তরঞ্জন মিষ্টান্ন ভান্ডার অতুলনীয় স্বাদের মিষ্টি ও ঘোলের জন্য সবচেয়ে প্রসিদ্ধ।
ভাগ্যকুল জমিদার বাড়ি
মিষ্টির দোকা থেকে এবার রওনা হয়ে যান ভাগ্যকুল জমিদার বাড়ির দিকে। বর্তমানে এটি বিক্রমপুর জাদুঘর ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। জমিদার যদুনাথ রায় আনুমানিক ১৯০০ সালে মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার ভাগ্যকুল গ্রামে ভাগ্যকুল জমিদার বাড়ি নির্মাণ করেন।
যদুনাথ রায় মূলত ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি বরিশাল থেকে লবণ, সুপারি, শাড়িসহ ইত্যাদি পণ্য আমদানি করে মুর্শিদাবাদে রপ্তানি করতেন। মানিকগঞ্জের বালিয়াটি জমিদার বাড়ির সাথে দোতলা ভাগ্যকুল জমিদার বাড়ির বেশ সাদৃশ্য রয়েছে। ভবনের সামনে আছে ৮টি থাম, যা মূলত গ্রীক স্থাপত্য শিল্পের বৈশিষ্ট নির্দেশ করে। মূল ভবনের ভেতরের দেয়ালে ময়ূর, সাপ ও বিভিন্ন ফুল-পাখির নকশা অঙ্কিত আছে। ভাগ্যকুল জমিদার বাড়ির দরজা ও জানালাগুলো একই আকারের ফলে বদ্ধ অবস্থায় দরজা-জানালার অনুমান করা বেশ কঠিন।
বাড়ির সব জায়গা জুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে মূল ভবন। তার মাঝখানে উঠানের অবস্থান। বাড়ির একতলা থেকে দোতলায় চলাচলের জন্য আছে একটি কাঠের সিঁড়ি। যদুনাথ সাহা তার ৫ ছেলে-মেয়ের জন্য পৃথক পৃথক বাড়ি নির্মাণ করেন। বাড়িগুলো স্থানীয় মানুষের কাছে কোকিলপেয়ারি জমিদার বাড়ি, উকিল বাড়ি, জজ বাড়ি ও ভাগ্যকুল জমিদার বাড়ি নামে পরিচিতি লাভ করে। জমিদার যদুনাথ রায়ের এ বাড়ির স্মৃতি রক্ষার্থে প্রায় সাড়ে ১৩ একর জায়গা জুড়ে অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ও সরকারি অর্থায়নে ২০১৪ সালে নির্মাণ করা হয়েছে জাদুঘর, গেস্ট হাউজ, থিমপার্ক।
- আরো পড়ুন: যুক্তরাজ্যে কেন পড়াশোনা করবেন?
- আরো পড়ুন: ফ্রান্সে আশ্রয়প্রার্থীরা কেমন আর্থিক সুবিধা পায়?
- আরো পড়ুন: পর্তুগালে পরিবার নিতে কি প্রয়োজন
তিনতলা ভবনের এ জাদুঘরে প্রবেশ করতেই দু’পাশে দুটি বড় মাটির পাতিলের দেখা পাবেন। নিচতলার বাম পাশের গ্যালারি যদুনাথ রায়ের নামে। এ গ্যালারিতে বিক্রমপুরের প্রাচীন মানচিত্র, রাঘুরামপুর, নাটেশ্বরসহ বিক্রমপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাওয়া পোড়া মাটির নল, মাটিরপাত্র, পোড়া মাটির খেলনাসহ প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন নিদর্শন আছে।
নিচতলার ডান পাশের গ্যালারিটি স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর নামে। এ গ্যালারিতে আছে ব্যাসাল্ট পাথরের বাটি, গামলা, পাথরের থালা, পোড়া মাটির ইট, টালি, বিক্রমপুরের নানা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনার ছবিসহ বিভিন্ন নিদর্শন। দ্বিতীয় তলার বাম পাশের মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারিতে আছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ছবি, ইতিহাস, দলিল, বই ও বিভিন্ন নমুনা। আর ডান পাশের গ্যালারিতে আছে বিক্রমপুরে জন্ম নেয়া মনীষীদের জীবন ও কর্মের বৃত্তান্ত। আরও আছে কাগজ আবিষ্কারের আগে প্রাচীন আমলে ভূর্জ গাছের বাকলে লেখার স্থান।
তালপাতায় লেখা পুঁথি, কাঠের সিন্দুক, আদি আমলের মুদ্রা, তাঁতের চরকা, পোড়া মাটির মূর্তি, সিরামিকের থালাসহ প্রাচীন আমলে স্থানীয় মানুষদের ব্যবহার্য বিভিন্ন নিদর্শন। বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাদে সপ্তাহের বাকি ৬ দিন জাদুঘরটি সর্বসাধারণের জন্যে উন্মুক্ত থাকে।
কীভাবে যাবেন?
ঢাকার গোলাপ শাহ মাজারের কাছ থেকে ঢাকা-দোহার রুটে চলাচলকারী বাসে চড়ে মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরের রাড়িখাল তিন দোকানের সামনে নামবেন। সেখান থেকে রিকশা ভাড়া করে জগদীশ চন্দ্র বসু কমপ্লেক্স যাওয়া যায়। আবার সেখান থেকে রিকশা বা অটোতে সহজেই যেতে পারবেন ভাগ্যকুল বাজার ও ভাগ্যকুল জমিদার বাড়ি। যেখানে কি না বর্তমানে গড়ে উঠেছে বিক্রমপুর জাদুঘর।
যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে।