রক্তের অজানা কিছু তথ্য জেনে রাখুন । আপনার ভবিষ্যতে কাজে আসতে পারে।
রক্তই প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলে জীবাণুর বিরুদ্ধে। দেহের অভ্যন্তরস্থ এসিড এবং ক্ষারের স্বাভাবিক মাত্রা বজায় রাখাও রক্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
প্রতি ফোঁটা রক্তে আছে ২৫০ মিলিয়ন বা ২৫ কোটি লোহিতকণিকা, ৪ লাখ শ্বেতকণিকা ও ২৫ মিলিয়ন বা আড়াই কোটি প্লাটিলেট। এ কণিকগুলো অনুজ্জ্বল হলদে রঙের এক তরল প্লাজমার মধ্যে ডুবে থাকে। লোহিতকণিকাগুলো ফুসফুস থেকে হৃৎপিণ্ড হয়ে সারা দেহে অক্সিজেন বয়ে নিয়ে যায় এবং সারা দেহের কোষ থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ফুসফুসে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। শ্বেতকণিকা দেহ-আক্রমণকারী জীবাণুকে ধ্বংস করে। আর জখমস্থানে রক্তকে জমাট বাঁধতে সহায়তা করে প্লাটিলেট। প্লাজমা এসব রক্তকণিকাগুলোকে সারা দেহে বয়ে নিয়ে বেড়ায়। পাশাপাশি রাসায়নিক পদার্থ ও পুষ্টি সরবরাহ করে দেহের বিভিন্ন অংশে।
- আরো পড়ুন:যেসব খাবারে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে
- আরো পড়ুন:রক্তের অজানা কিছু তথ্য জেনে রাখুন
- আরো পড়ুন:পুরুষের যৌন শক্তি বৃদ্ধি, ঘরোয়া উপায় জেনে নিন
প্রতি ২৪ ঘন্টায় একজন মানুষের হৃৎপিণ্ড ১২ হাজার মাইল রক্তবাহী শিরা ও ধমনীর মধ্য দিয়ে ৮ হাজার গ্যালন রক্ত পাম্প করে। হৃৎপিণ্ড সবসময়ই রক্ত পাম্প করছে। স্বাভাবিক অবস্থায় পাম্প করা রক্তের শতকরা ১৫ ভাগ সরাসরি চলে যায় মস্তিষ্কে, ২৫ ভাগ যায় কিডনিতে। পেশিগুলোতে যায় ২০ ভাগ। হৃৎপিণ্ডের নিজেরও পর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহ প্রয়োজন হয়।
রক্তের লোহিতকণার আবরণে বিশেষ বিশেষ ধরনের যৌগিক পদার্থ থাকে, যাকে বলে এন্টিজেন। ২ ধরনের এন্টিজেন রয়েছে। একটির নাম A অপরটির নাম B। রক্তের লোহিতকণার আবরণে শুধু A এন্টিজেন থাকলে রক্তের গ্রুপ হবে A, শুধু B এন্টিজেন থাকলে রক্তের গ্রুপ হবে B, A ও B উভয় এন্টিজেন থাকলে রক্তের গ্রুপ হবে AB আর A বা B কোনো এন্টিজেন-ই না থাকলে রক্তের গ্রুপ হবে O।
লোহিতকণার আবরণে যেমন এন্টিজেন থাকে তেমনি রক্তরসে থাকে এন্টিবডি, সাধারণত ২ ধরনের এন্টিবডি দেখা যায়- Anti-A এবং Anti-B। বিপরীতধর্মী Antigen ও Antibody পরস্পরকে ধ্বংস করে। এ জন্যে যার রক্তকণায় A এন্টিজেন (Blood Group-A) আছে, তার রক্তরসে আছে Anti-B Antibody। তেমনি যার রক্তকণায় B Antigen (Blood Group-B) আছে তার রক্তরসে আছে Anti-A Antibody।
যার রক্তকণায় A ও B উভয় Antigen-B আছে (Blood Group-AB) তার রক্তরসে কোনও Antibody নেই। আর যার রক্তে AB কোনো Antigen-B নেই (Blood Group-O) তার রক্তরসে Anti-A এবং Anti-B উভয় Antibody-B আছে।
রক্তসঞ্চালনের ক্ষেত্রে দাতা ও গ্রহীতার একই রক্তগ্রুপ হতে হবে। রক্তগ্রহীতাকে ভিন্ন গ্রুপের রক্ত দেয়া হলে Antigen ও Antibody এর প্রতিক্রিয়ায় রক্তকণাগুলো ভেঙে গিয়ে তাল পাকিয়ে যায় ও রক্তনালী বন্ধ হয়ে গিয়ে বিপদ, এমনকি মৃত্যুও ঘটতে পারে।
O গ্রুপের রক্তকণায় কোনো Antigen নেই। তাই O গ্রুপের অল্প পরিমাণ রক্ত যেকোনো গ্রুপের মানুষের শরীরে দেওয়া যায়। তাই O গ্রুপের দাতাকে সার্বজনীন দাতা বলে। AB গ্রুপের রক্তরসে কোনো Antibody নেই। তাই অন্য যেকোনো গ্রুপের অল্প পরিমাণ রক্ত AB গ্রুপের মানুষের শরীরেও দেওয়া যায়। তাই AB গ্রুপের মানুষকে সার্বজনীন গ্রহীতা বলে। তবে সবসময় সঠিক গ্রুপের রক্তসঞ্চালনই নিরাপদ। অত্যন্ত জরুরি অবস্থা ছাড়া কখনোই সার্বজনীন দাতা বা সার্বজনীন গ্রহীতার ধারণার প্রয়োগ ঘটানো হয় না।
রক্তসঞ্চালনের ক্ষেত্রে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ রক্তগ্রুপ হলো রেসাস গ্রুপ বা রেসাস ফ্যাক্টর। যে মানুষের রক্তের লোহিতকণায় অনুরূপ যৌগ থাকে তাদের রক্তকে আরএইচ পজিটিভ বলা হয় আর যাদের রক্তে এই ধরনের যৌগিক পদার্থ থাকে না তাদের রক্তকে আরএইচ নেগেটিভ বলা হয়। রক্তের গ্রুপ বলতে ABO কোনটি এবং তার সাথে Rh Positive না Rh Negative বলতে হয়।
বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর রক্তের গ্রুপভিত্তিক হার
A= ২২.৪৪ শতাংশ,
B= ৩৫.২০ শতাংশ,
O= ৩৩.৯৭ শতাংশ ও
AB= ৮.৩৯ শতাংশ।
বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর রক্তের রেসাস ফ্যাক্টর হার
Rhesus Positive = 97.44 শতাংশ,
Rhesus Negative = 2.56 শতাংশ
রক্ত পরিসঞ্চালনের প্রয়োজন হয় সাধারণত নিম্নোক্ত ক্ষেত্রগুলোতে
বড় অপারেশনে, বড় দুর্ঘটনায় বেশি রক্তক্ষরণ হলে, প্রসূতির রক্তক্ষরণে, নবজাতকের রক্তরোগের চিকিৎসায়, ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসার সহায়তায়, অগ্নিদগ্ধ রোগীর চিকিৎসায়, রক্তস্বল্পতা রোগের চিকিৎসায় ও থ্যালাসেমিয়া, হিমোফিলিয়া ইত্যাদি বংশগত রক্তরোগে।
কৃত্রিম উপায়ে রক্ত তৈরি করা যায় না এবং অন্য কোনো প্রাণীর রক্ত মানুষের শরীরে সঞ্চালন করা যায় না। একজন মানুষের প্রয়োজনে আরেকজন মানুষ রক্ত না দিলে রক্ত পাওয়ার আর কোনো বিকল্প নেই।
রক্তদান কতটা নিরাপদ এটা নিয়ে কারো কারো মধ্যে সংশয় আছে। রক্তদানের কোনো ঝুঁকি নেই। একজন পুরুষের শরীরে ওজনের কেজিপ্রতি ৭৬ মিলিলিটার এবং নারীদের শরীরে ওজনের কেজিপ্রতি ৬৬ মিলিলিটার রক্ত থাকে। সবারই কেজিপ্রতি ৫০ মিলিলিটার রক্ত সংবহনের কাজে লাগে, বাকিটা উদ্বৃত্ত। অর্থাৎ পুরুষের ওজনের কেজিপ্রতি ২৬ মিলিলিটার ও নারীদের ওজনের কেজিপ্রতি ১৬ মিলিলিটার রক্ত উদ্বৃত্ত। ফলে ৫০ কেজি ওজনের একজন পুরুষের উদ্বৃত্ত রক্তের পরিমাণ 50×26=1300 মিলি এবং একই ওজনের একজন নারীর শরীরে উদ্বৃত্ত রক্তের পরিমাণ 50×16=800 মিলি। স্বেচ্ছা রক্তদানে একজন দাতার কাছ থেকে ৩৫০ থেকে ৪০০ মিলিলিটার রক্ত সংগ্রহ করা হয়, যা তার শরীরের উদ্বৃত্ত রক্তের অর্ধেকেরও কম। ফলে রক্তদানে শারীরিক ক্ষতি হওয়ার কোনো আশঙ্কা নাই।
৩ ধরনের রক্তকণিকা আছে—লোহিত কণিকা, শ্বেত কণিকা এবং অনুচক্রিকা। রক্তের শতকরা ৪৫ ভাগই রক্তকণিকা। বাকি ৫৫ ভাগ রক্তরস বা প্লাজমা, যার শতকরা ৯২ ভাগই জল।
- আরো পড়ুন:শারীরিক সম্পর্ক ছাড়াও ৬ কারণে হতে পারে এইডস
- আরো পড়ুন: জেনে রাখুন কিডনি রোগের ঘরোয়া ৮টি নিয়মে মিলবে সুরক্ষা
- আরো পড়ুন:শিশুর ডায়রিয়া হলে কি করণীয়?
রক্তকণার মধ্যে লোহিতকণা কোষে অক্সিজেন নিয়ে যায় আর কার্বন-ডাই-অক্সাইড ফিরিয়ে তা নিয়ে আসে হৃৎপিণ্ডে। শ্বেতকণা বিভিন্ন ধরনের জীবাণুর আক্রমণ থেকে শরীরকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। অনুচক্রিকা রক্তক্ষরণের ক্ষেত্রে রক্তকে জমাট বাঁধিয়ে রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে সাহায্য করে। প্লাজমা মূলত কণাগুলোকে বহন করে আর খাদ্য ও বাহ্য পদার্থ (ভিটামিন, হরমোন ইত্যাদি) পরিবহন করে। রক্তকণাগুলোর প্রত্যেকটির নির্দিষ্ট আয়ু আছে। সবচেয়ে বেশিদিন বাঁচে লোহিত কণা, আয়ু ১২০ দিন মাত্র। বিভিন্ন ধরনের শ্বেতকণার আয়ু ভিন্ন ভিন্ন, ২-১০ দিন। অনুচক্রিকা ২ দিন পর্যন্ত বাঁচে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলেন, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নিয়মিত ৩-৪ মাস অন্তর রক্তদান করতে পারে। এতে শারীরিক ক্ষতির কোনো আশঙ্কা নেই; বরং তা রক্তদাতার শারীরিক সুস্থতাকেই বাড়িয়ে দেয়।
যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন।