ফিরোজ মাহমুদ :: ঈদ আরবি শব্দ। যার অর্থ ফিরে আসা।এমন দিনকে ঈদ বলা হয় সে দিন মানুষ একত্র হয় ও দিনটি বারবার ফিরে আসে। এ শব্দ দ্বারা এ দিবসের নাম রাখার তাৎপর্য হলো আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ দিবসে তাঁর বান্দাদেরকে নিয়ামত ও অনুগ্রহ দ্বারা বারবার ধন্য করেন ও বার বার তাঁর ইহসানের দৃষ্টি দান করেন। যেমন রামাযানে পানাহার নিষিদ্ধ করার পর আবার পানাহারের আদেশ প্রদান করেন। আর এ সকল নিয়ামত ফিরে পেয়ে ভোগ করার জন্য অভ্যাসগতভাবেই মানুষ আনন্দ ফুর্তি করে থাকে।
ঈদে আমরা যা করবো ঃ ঈদ আমাদের জন্য এক বিরাট নিয়ামত। কিন্তু আমরা এ দিনটিকে নিয়ামত হিসাবে গ্রহন করি না। এ দিনে অনেক কাজ আছে যার মাধ্যমে আমরা আল্লাহ নিকটবর্তী হতে পারি এবং ঈদ উদযাপন ও একটি ইবাদতে পরিনত হতে পারে।
১। ফজরের নামাজ জামায়াতে আদায় করা ঃ আমাদের দেশে অনেকেই ফজরের নামাজ আদায় করে না। ঈদের জন্য ফজরের নামাজ জামায়াতে পড়ার গুরুত্ব ও দেয় না। অথচ ফজরের নামাযের গুরুত্ব অপরিসীম। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘যদি তারা ঈশা ও ফজর নামাযের মধ্যে কি আছে তা জানতে পারতো তবে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও এ দুটি নামাজের জামায়াতে শামিল হত।” (বুখারী ঃ ৬১৫)
২্ ঈদের সালাত আদায় করা ঃ ঈদের দিনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন বিষয় হলো ঈদের সালাত আদায় করা। প্রকৃত পক্ষে একজন ঈমানদার বান্দাহ সালাত আদায়ের মাধ্যমে বেশী আনন্দিত হয়ে থাকে। হাদীসে এসেছে “নবী করীম (স:) ঈদুল ফিতরের দিনে বের হয়ে দু’রাকাত ঈদের সালাত আদায় করেছেন। এর পূর্বে ও পরে অন্য কোন সালাত আদায় করেননি। (বুখারী ঃ ৯৮৯)
৩। ঈদের দিন গোসল করা ঃ ঈদের দিন গোসল করার মাধ্যমে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা একান্ত প্রয়োজন। কেননা এ দিনে সকল মানুষ সালাত আদায়ের জন্য মিলিত হয়। ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্নিত যে, ‘তিনি ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদগাহ যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন।” (সুনানে বায়হাকী ঃ ৫৩৩)
৪। পায়ে হেটে ঈদগাহে যাওয়া ঃ আর ঈদগাহে পায়ে হেটে যাওযা হল সুন্নাহর অন্তর্ভূক্ত। আলী (রাঃ) থেকে বর্নিত, তিনি বলেন: সুন্নাহ হল ঈদগাহে পায়ে হেটে যাওয়া। (সুনানে আত-তিরমিযী) উভয় পথের লোকদের সালাম দেয়া ও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করার জন্য যে পথে যাবে, সে পথে না ফিরে অন্য পথে ফিরে আসা। হাদীসে বর্ননা করা হয়েছে, নবী কারীম (সা:) ঈদের দিনে পথ বিপরীত করতেন। (বুখারী ঃ ৯৮৬)
৫। ঈদের দিনে খাবার গ্রহন ঃ ঈদুল ফিতরে দিনে ঈদের সালাত আদায়ের পূর্বে খাবার গ্রহন করা এবং ঈদুল আজহার দিন ঈদের সালাতের পূর্বে কিছু না খেয়ে সালাত আদায়ের পর কুরবানির গোশত খাওয়া সুন্নত। (সুনানে আত-তিরমিযী: ৫৪৫)
৬। ঈদে শুভেচ্ছা বিনিময়ের ভাষা ঃ হাফেজ ইবনে হাজার (রাহঃ) বলেছেন, সাহাবায়ে কিরামগন ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অপরকে বলতেন: ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়ামিনকা’ অর্থ- আল্লাহ তা’আলা আমাদের ও আপনার ভাল কাজগুলো কবুল করুন। আবার ঈদ মুবারক ইনশাআল্লাহ। ‘ঈদকুম সাঈদ‘ বলে ঈদে শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়।
৭। ঈদের চাঁদ দেখার পর থেকে তাকবীর পাঠ করা ঃ তাকবীর হলো ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার। আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার। ওয়া লিল্লাহিল হামদ। বাক্যটি উচ্চস্বরে পড়া।
৮। নতুন বা উত্তম পোশাক পরিধান করা ঃ ইবনে কায়্যিম (রাহঃ) বলেছেন ঃ “নবী করীম (সা:) দু ঈদেই ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে সর্বোত্তম পোশাক পরিধান করতেন। (যাদুল মায়াদ)
৯। ঈদের খুতবা শ্রবন করা।
১০। দোয়া ইস্তেগফার করা।
১১। ফিতরাহ দেয়া।
১২। ইয়াতীম ও অভাবীকে খাবার খাওয়ানো।
১৩। আত্মীয়-স্বজনদের খোঁজ খবর নেয়া।
১৪। মন-মালিন্য দূর করা, ইত্যাদি।
ঈদে যা বর্জনীয়:
ঈদ মুসলিম জাতির গুরুত্বপূর্ণ উৎসব আর আমাদের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি। আমরা ঈদ পালনে ইসলাম সমর্থন করে না এমন সব সংস্কৃতিতে নিমজ্জিত হচ্ছি। যা আমাদের বর্জন করা দরকার। ঈদে বর্জনীয় বিষয় গুলো তুলে ধরছি ঃ
বিজাতীয় আচরন প্রদর্শন ঃ বিজাতীয় আচরন মুসলিম সমাজে ব্যপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। পোশাক-পরিচ্ছেদে, চাল-চলনে, শুভেচ্ছা বিনিময়ে অমুসলিমদের অনুকরনে লিপ্ত হয়ে পড়েছে মুসলমানদের অনেকেই। আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) থেকে বর্নিত, রাসূল (সাঃ) বলেছেন “যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাথে সাদৃশ্যতা রাখবে সে তাদের দলভূক্ত বলে গণ্য হবে।” (আবু দাউদ- ৪০৩৩)
নারী পুরুষ একে অপরের বেশ ধারন পোষাক পরিচ্ছেদ চাল চলন ও সাজ সজ্জার ক্ষেত্রে পুরুষ নারীর বেশ ধারন ও নারী পুরুষের বেশ ধারন হারাম। ঈদের দিনে এ কাজটি অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। হাদীস থেকে যানা যায় রাসূল (সাঃ) পুরুষের বেশ ধারনকারী নারী ও নারীর বেশ ধারী পুরুষকে অভিসম্পাদ করেছেন। (আবু দাউদ- ৪০৯৯)
নারীদের খোলামেলা অবস্থায় রাস্তা-ঘাটে বের হওয়াঃ ঈদের দিনে নারীদের বেপর্দা অবস্থায় রাস্তা-ঘাটে বের হওয়া যাবে না। এ বিষয়ে কুরআনুল কারীমে মহান আল্লাহ বলেন- ‘আর তোমরা নীজ ঘরে অবস্থান করবে এবং প্রচীন মুর্খতার যুগের মতো নিজেদের প্রদর্শন করে বেড়াবে না। (সূরা আহযাব ৩৩) সুতরাং নারীগন পর্দা পালন করে বের হবে।
গান বাজনা করা অশ্মীল সিনেমা ও নাটক দেখাঃ ঈদ উপলক্ষে বিশেষ নাটক, গান-বাজনা যা ইসলাম অনুমোদন করে না, তা থেকে বিরত থাকতে হবে। রাসূল (সাঃ) বলেছেন ‘আমার উম্মতের মাঝে এমন একটা দল পাওয়া যাবে যারা ব্যভিচার, রেশমী পোশাক, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে বৈধ মনে করবে।’ (সহী বুখারী ৫৫৯০)
বেহুদা কাজে সময় ব্যয় করাঃ অনেকে বেহুদা কাজে ঈদে রাত জাগরন ও দিনে বেহুদা কাজে সময় নষ্ট করে থাকেন, সেজন্য বেহুদা কাজে সময় নষ্ট করা থেকে বিরত থাকা দরকার। জামাতের সাথে ফরজ সালাত আদায়ে অলসতা করাঃ ঈদের আনন্দে এমন ভাবে উদাসীন থাকেন যে, ফরজ সালাত আদায়ে অলসতা করেন। যা গ্রহনযোগ্য নয়। ঈমানদার বান্দাগন সালাত আদায়ে কোন গাফেলতি করে না। (সূরা মায়ারিজ ৩৪)
অবাদে নারীদের সাথে দেখা সাক্ষাতঃ দেখাযায় অন্যান্য সময়ের চেয়ে এই গুনাহের কাজটি ঈদের দিনে বেশি করা হয়। নীকট আত্মীয়দের মাঝে যাদের সাথে দেখা সাক্ষাত শরীয়ত অনুমোদিত নয়, তাদের সাথে অবাদে দেখা সাক্ষাত করা হয়। রাসূল (সা:) বলেন ‘তোমরা মহিলাদের সাথে দেখা সাক্ষাত করা থেকে নিজেদের বাচিয়ে রাখবে।’ (বুখারী ৫২৩২)
অপচয় ও অপব্যয় করা ঃ ঈদের কেনাকাটা থেকে শুরু করে এ উপলক্ষে সবকিছুতেই অপচয় ও অপব্যয় করা হয়। অথচ কুরআনে বলা হয়েছে- ‘আর তোমরা কোন ভাবেই অপব্যয় করো না, নিশ্চই অপব্যয় কারী শয়তানের ভাই।’ (সূরা বনি ইসরাইল ২৬২৭)
মানুষকে কষ্ট দেয়া ঃ ঈদের দিনে অনেকে এমন কাজ করেন যা মানুষকে কষ্ট দেয়। যেমন- রাস্তা আঁকিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা নেয়া, এমন আনন্দ করা যাতে অন্যরা কষ্ট পায়। হাদীস রাসূল (সাঃ) বলেন ‘মুসলিম ঐ ব্যক্তি যার হাত ও জিহবা থেকে অন্যরা নিরাপদ। (বুখারী ৬৪৮৪)
ঈদের সালাত আদায় না করে কেবল আনন্দ ফুর্তি করাঃ অনেকেই ঈদের আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে নতুন জামা-কাপর পরিধান, সেমাই, ফিরনি ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ঈদের সালাত আদায় করার কথা ভূলে যান। অথচ ঈদের দিনে ঈদের সালাত আদায় করা হচ্ছে মূল করণীয়।
ঈদ একটি ইবাদত। আনন্দ ও ফুর্তি করার মাধ্যমেও যে ইবাদত পালন করা যায়, ঈদ তার অন্যতম উদাহরন। শরীয়া সম্মত ভাবে আনন্দ প্রকাশ করার বিষয় কোরআনে এসছে। ‘বল এটা আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত, সুতরাং এ নিয়েই যেন তারা খুশি হয়। এটি যা তারা জমা করে তা থেকে উত্তম। (সূরা ইউনূস ৫৮)
আল্লাহর শেষ্ঠত্ব প্রকাশ এবং শুকরিয়া আদায়ের মাধ্যমে আমরা ঈদ উদযাপন করবো, ইনশাআল্লাহ। এ বিষয় আল কুরআনে আরও বলা হয়েছে- ‘আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরন কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে হেদায়াত দিয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষনা কর এবং যাতে তোমরা শোকর কর। (বাকারা ১৮৫)
লেখক: মাদ্রাসা শিক্ষক ও গণমাধ্যম ব্যাক্তিত্ব
যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুণ।