বাংলা ভাষা ও উপভাষা

বাংলা ভাষা ও উপভাষা কি! সাধু থেকে চলিত ভাষায় রূপান্তর, ভাষা হল মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যম। মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য মানুষ বাকযন্ত্রের সাহায্যে যে অর্থবোধক ধ্বনি উচ্চারণ করে তাকেই বলা হয় ভাষা। অন্যভাবে বললে, ভাষা হল মানুষের ভাব প্রকাশ করার ধ্বনিভিত্তিক, অর্থবোধক নিরাকার ব্যবস্থা। ডঃ সুকুমার সেনকে অনুসরণ করে বলা যায়, “মানুষের উচ্চারিত, অর্থবহ বহুজনবোধ্য ধ্বনিসমষ্টিই ভাষা”। সেই হিসেবে ভাষার উপাদান হল ধ্বনি ও অর্থ এবং এর শর্ত হল বহুজনবোধ্যতা। শুধু নিজে বুঝলেই হয় না অপরকেও বুঝতে হবে, তবেই তাকে ভাষা বলা যাবে।

সূচিপত্র

  1. ভাষা এবং উপভাষা
  2. বাংলার উপভাষাসমূহ
  3. রাঢ়ী উপভাষা
  4. বঙ্গালি উপভাষা
  5. বরেন্দ্রী উপভাষা
  6. কামরূপী উপভাষা
  7. ঝাড়খন্ডি উপভাষা
  8. মান্য বাংলা উপভাষা কোনটি এবং কেন?
  9. সাহিত্যের ভাষা
  10. সাধু এবং চলিত ভাষার পার্থক্য
  11. সাধু থেকে চলিত ভাষায় রূপান্তর

উপভাষা

উপভাষা–ভাষার ব্যবহারিক রূপ হল উপভাষা। যে জনসমষ্টি একটি নির্দিষ্ট ভাষায় কথা বলে সেই জনসমষ্টিকে উক্ত ভাষার ভাষাসম্প্রদায় বলা হয়। কিন্তু এই জনসমষ্টি যদি বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে ছড়িয়ে থাকে তবে তাদের ভাষার মধ্যে ধ্বনিতাত্ত্বিক এবং রূপতাত্ত্বিক তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। স্থানভেদে ভাষার এই রূপভেদ অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। ভাষার এই আঞ্চলিক রূপভেদকেই বলা হয় উপভাষা। ডঃ সুকুমার সেনের মতে, “কোন ভাষাসম্প্রদায়ের অন্তর্গত ছোট ছোট দলে বা অঞ্চলে বিশেষ প্রচলিত ভাষাছাঁদকে উপভাষা বলে”।

আরো পড়ুন: বাংলা ব্যাকরণ সকল শ্রেণীর জন্য

বাংলার উপভাষাসমূহ

কথ্য বাংলার প্রধান উপভাষার সংখ্যা পাঁচটি। উপভাষাগুলি হল(১) রাঢ়ী, (২) বঙ্গালি, (৩) বরেন্দ্রী, (৪) ঝাড়খণ্ডি ও (৫) কামরুপী। আচার্য সুনীতিকুমারকে অনুসরণ করে একটি সুন্দর উদাহরণের সাহায্যে বাংলার এই পাঁচটি উপভাষার বৈশিষ্ট্যগুলি তুলে ধরা হল-

রাঢ়ী উপভাষা সে একজন চাকরকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে—এসব ব্যাপার হচ্ছে কেন? তাতে চাকরটি বললে—আপনার ভাই ফিরে এসেছেন, আর আপনার বাবা তাকে ভালােয় ভালােয় ফিরে পেয়েছেন বলে খাওয়ান-দাওয়ান নাচ-গান করছেন।

বঙ্গালী উপভাষা সে একজন চাকররে ডাইক্যা জিগগাসা কৈল্লো- ইয়ার মানে কি ? সে কৈলাে- তােমার বাই আইচে, তারে বা’লে বা’লে পাইয়া তােমার বাপে এক খাওন দিচেন।

বরেন্দ্রী উপভাষা তাঁর একজন চেঙ্গরাক্ ডাকেয়া পুছ করিল—ইগলা কি? তখন তাঁর তাক্ কইল-“তাের ভাই আইচ্চে, তাের বাপ্ তাক্ ভালে-ভালে প্যায়া একটা বড় ভাণ্ডারা করচে।

[কামরুপী উপভাষা] হে একজন চাকরকে ডাইক্যা জিঘাইল—এ হক্কল [ ইতা ] কিয়র? হে তাকে কইল,-তুমার বাই বারীৎ আইছে, এর লাইগা তুমার বাপ বর’ খানি দিছইন্, কারণ তারে ভালা-আপ্তা ফিরা পাইছইন্।

ঝাড়খণ্ডী উপভাষা সে একজন মুনিশকে বুলিয়ে পুছলেক্ যে এসব কিসের লিয়ে হচ্ছে রে? মুনিশটা বললেক্—তুমার ভাই আইছেন্ ন, এহাতে তুমার বাপ কুটুম খাওয়াছেন, কেন্ না উহাকে ভালায় ভালায় পাওয়া গেল্ ছে।

রাঢ়ী উপভাষা

রাঢ়ী উপভাষা মূলত রাঢ় অঞ্চলে প্রচলিত। কলকাতা, হাওড়া, হুগলি, বর্ধমান, নদিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার, পূর্ব মেদিনীপুর ও পশ্চিম মেদিনীপুরের কিছু অংশ।

ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য
১. অভিশ্রুতির ব্যাপক প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। যেমন- করিয়া>করে, বলিয়া>বলে, দেখিয়া> দেখে ইত্যাদি।

২. স্বরসঙ্গতির ব্যবহারও লক্ষণীয়। যেমন- দেশি>দিশি, বিলাতি>বিলিতি, পূজা>পুজো ইত্যাদি।

৩. শব্দের আদ্য অক্ষর অ-কার থাকলে সেটি ও-কার রূপে উচ্চারিত হয়। যেমন- অতুল> ওতুল, বন> বােন, মন> মােন, সত্য>সোত্ত, প্রতি> প্রােতি ইত্যাদি।

৪. শব্দের শেষে অঘােষধ্বনি থাকলে সেটি ঘােষধ্বনিতে পরিণত হয়। যেমন-শাক> শাগ, কাক>কাগ ইত্যাদি।

রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য
১. কর্ম কারকে এবং নিমিত্ত কারকে ‘কে’ বিভক্তির প্রয়োগ।

২. অধিকরণ কারকে ‘তে’ বিভক্তির প্রয়োগ।

৩. ভবিষ্যৎ কালে ক্রিয়াপদের সঙ্গে ‘ব’, ‘বে’, ‘বেন’ বিভক্তি যুক্ত থাকে।

৪. একবচনে টি, টা এবং বহুবচনে গুলো, গুলি নির্দেশক যুক্ত হয়।

বঙ্গালি উপভাষা

অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, খুলনা, যশোর, চট্টগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চলে প্রচলিত।

ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য
১. অপিনিহিতির বহুল প্রয়োগ হয়। যেমন- দেখিয়া> দেইখ্যা, জালিয়া>জাইল্যা ইত্যাদি।

২. শব্দের আদিতে অবস্থিত ও-কার উ-কারে পরিণত হয়। যেমন- তোর> তুর, চোর>চুর, বােন>বুন ইত্যাদি।

৩. যুক্ত ব্যঞ্জন ও য-ফলান্ত শব্দে ‘ই’ ধ্বনির ব্যাপক আগম ঘটে। যেমন- ভব্য> ভইব্য, পদ্য>পইদ্য, সত্য>সইত্য ইত্যাদি।

৪. শব্দের আদিতে ‘এ’ থাকলে ‘অ্যা’ উচ্চারণ হয়। যেমন- দেশ>দ্যাশ, মেঘ>ম্যাঘ, বেল> ব্যাল ইত্যাদি।

৫. অনেকসময় ‘ড়’ এবং ‘ঢ়’ ধ্বনি ‘র’ উচ্চারিত হয়। যেমন- বাড়ি>বারি, ঘােড়া>ঘোরা, দাঁড়াও> দাঁরাও ইত্যাদি।

৬. ‘চ’-এর উচ্চারণ ‘ৎস’-এর মতাে হয়।

৭. ‘ছ’-এর উচ্চারণ ‘স’-এর মতো হয়।

৮. শ, ষ, স-এর উচ্চারণ কখনো ‘হ’-এর মতাে হয়। যেমন- সে>হে, শােনা>হােনা, শুনবে> হুনবে ইত্যাদি।

৯. মহাপ্রাণ ধ্বনির অল্পপ্রাণিভবন ঘটে। যেমন- ভাত> বাত, বাঘ> বাগ ইত্যাদি।

রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য
১. কর্তৃকারকে ‘এ’ বিভক্তির ব্যাপক প্রয়োগ। যেমন : বাপে কইলাে, অরে বাগে খাইসে।

২. ‘কে’ এবং ‘দের’ পরিবর্তে যথাক্রমে ‘রে’ এবং ‘গো’ ব্যবহার হয়। যেমন- আমারে দাও, আমাগো বাংলাদেশ ইত্যাদি।

৩. ক্রিয়ার ঘটমান বর্তমানের রূপ- ‘ত্যাছি’, ‘ত্যাছ’, ‘ত্যাছে’ দিয়ে নিম্পন্ন হয়।

৪. পুরাঘটিত বর্তমান ‘সি’, ‘স’ এবং ‘সে’ দিয়ে নিষ্পন্ন হয়। যেমন- পইড়্যাসি, খাইয়্যাস, দেইখ্যাসে ইত্যাদি।

৫. সাধারণ ভবিষ্যৎ কাল বোঝাতে উত্তম পুরুষে ‘মু’, ‘উম’ এবং মধ্যম পুরুষে ‘বা’ বিভক্তি যোগ হয়। যেমন- তুমি কি যাবা না? আমি যামু ইত্যাদি।

বরেন্দ্রী উপভাষা

মালদহ, দক্ষিণ দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়া, পাবনায় প্রচলিত।

ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য
১. ‘জ’ ব্যঞ্জনের উচ্চারণ ইংরেজী ‘z’-এর মতাে।

২. অল্পপ্রাণিভবনের ব্যাপক ব্যবহার হয়। যেমন- আধখানা>আদখানা, বাঁধ>বাঁদ, বাঘ> বাগ ইত্যাদি।

৩. ‘অ’ ধ্বনি ‘র’ তে রূপান্তরিত হয় এবং ‘র’ লোপ পায়। যেমন- আমের রস> রামের অস।

রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য
১. অতীতকালে ক্রিয়াপদের প্রথম পুরুষে ‘ল’ প্রত্যয়ের ব্যবহার। যেমন- খাইল, আইল ইত্যাদি।

২. পুরাঘটিত বর্তমান কালের ক্রিয়ায় অন্তিম ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব হয়। যেমনঃ আইচ্চে, খাইচ্চে ইত্যাদি।

৩. অধিকরণে ‘ত’ বিভক্তির ব্যবহার হয়। যেমন- বনত বাগ আসে।

কামরূপী উপভাষা

উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, উত্তর দিনাজপুর, বাংলাদেশের রংপুর, শ্রীহট্ট অঞ্চলে প্রচলিত।

ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য
১. জ’-এর উচ্চারণ ইংরেজী ‘z’-এর মতাে হয়।

২. ‘চ’-এর উচ্চারণ ‘ৎস’-এর মতাে হয়।

৩. ‘ছ’-এর উচ্চারণ ‘স’-এর মতাে হয়।

৪. শ, ষ, স-এর উচ্চারণ ‘হ’-এর মতাে হয়।

৫. অপিনিহিতির ব্যবহার হয়।

রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য
১. অতীতকালবাচক ক্রিয়াপদের প্রথম পুরুষে ‘ল’ প্রত্যয়ের ব্যবহার। যেমন- কইল, আইল, জিগাইল ইত্যাদি।

২. কর্মকারকে ‘রে’ বিভক্তির প্রয়ােগ হয়। যেমন- তারে, চাকররে ইত্যাদি।

৩. অধিকরণে ‘ত’ বিভক্তি হয়। যেমন- ঘরেত (ঘরে), বনেত (বনে) ইত্যাদি।

৪. উত্তম পুরুষে একবচনের সর্বনাম মুই, হাম।

ঝাড়খন্ডি উপভাষা

ঝাড়খন্ড রাজ্যের মানভূম, সিংভূম, ধলভূম, পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, দক্ষিণ-পশ্চিম মেদিনীপুর, দক্ষিণ-পশ্চিম বাঁকুড়ায় প্রচলিত।

ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য
১. নাসিক্যভবনের প্রবণতা অত্যধিক। যেমন- হাসপাতাল>হাঁসপাতাল, পেতল> পেঁতল, হামাগুড়ি> হাঁমাগুঁড়ি ইত্যাদি।

২. শব্দ-মধ্যবতী অল্পপ্রাণ বর্ণের মহাপ্রাণতা। যেমন- পুকুর>পখুর, শালিক> শালিখ ইত্যাদি।

৩. ও-কার অ-কারে পরিণত হয়। যেমন- চোর> চর, টোপ>টপ, ঢোক> ঢক ইত্যাদি।

রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য
১. ভবিষ্যৎ কালের ক্রিয়াপদে বহুলভাবে ‘ক’ প্রত্যয়ের যােগ। যেমন- যাবেক, খাবেক ইত্যাদি।

২. ‘আছ’ ধাতুর পরিবর্তে ‘বট্’ ধাতুর প্রয়োগ।

৩. অধিকরণ কারকে ‘ক’ বিভক্তির ব্যবহার। যেমন- ‘ঘরকে যাবক নাই’।

৪. বহুবচনে ‘গুলা’ ও ‘গুলান’-এর ব্যবহার। যেমন- ছেলাগুলান, গাছগুলা ইত্যাদি।

৫. নামধাতুর বহুল ও বিচিত্র প্রয়ােগ। যেমন- ‘খুব জাড়াচ্ছে’, ‘ঘরটা গঁধাচ্ছে’ ইত্যাদি।

মান্য বাংলা উপভাষা কোনটি এবং কেন?

বাংলার উপভাষা পাঁচটি। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন এসে যায়, কোন উপভাষাটি আদর্শ বাংলা ভাষা? উত্তর হল রাঢ়ী উপভাষা। রাঢ়ী উপভাষা কীভাবে আদর্শ বাংলা ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি বা মান্যতা লাভ করল? সে আলোচনায় যাওয়ার আগে জেনে নেব, আদর্শ ভাষা বলতে ঠিক কী বোঝায়।

বাংলার মতো বহু উপভাষাবিশিষ্ট ভাষার ক্ষেত্রে একটি উপভাষাকে আদর্শ বা মান্য ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কোনো উপভাষাকে আদর্শ বা মান্য ভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থ হল-

১) সরকারি নথি এবং বিজ্ঞপ্তিতে সেই উপভাষা ব্যবহৃত হবে;
২) সেই উপভাষাটি হবে সাহিত্য রচনার আদর্শ ভাষা;
৩) সেই উপভাষাকে কেন্দ্র করে উক্ত ভাষার ব্যাকরণ রচিত হবে;
৪) অন্য ভাষার রচনা অনুবাদ করতে হলে আদর্শ উপভাষাটি হয় অনুবাদের ভাষা। যেমন, কোনো ইংরেজি উপন্যাস বাংলায় অনুবাদ করতে হলে অনুবাদকৃত ভাষাটি হবে রাঢ়ী উপভাষা- বরেন্দ্রী বা বঙ্গালি উপভাষায় হওয়ার কথা নয়।

এবারে আসা যাক সেই প্রশ্নে- রাঢ়ী উপভাষা কীভাবে আদর্শ বাংলা হয়ে উঠল? আসলে রাঢ়ী উপভাষা যে অঞ্চলে কথিত হয়, (অর্থাৎ, ভাগীরথি-হুগলি নদীর তীরবর্তী অঞ্চলসমূহ) সেই অঞ্চলটি ঐতিহাসিক কাল থেকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কারণে এইসব অঞ্চলে বাইরে থেকে বহু মানুষ যাতায়াত করত। এই অঞ্চলটি রাজনৈতিক দিক থেকেও নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একসময় কলকাতা ছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানি (১৯১১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত)।

তাই নানান প্রয়োজনে অন্যান্য অঞ্চলের মানুষ কলকাতায় আসত। তাছাড়া, পূর্ব ভারতে স্বদেশি আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কলকাতা। এইসব কারণে কলকাতা এবং সংলগ্ন অঞ্চলের কথ্য বাংলা অর্থাৎ রাঢ়ী উপভাষা মান্য বাংলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল।

সাহিত্যের ভাষা

এতক্ষণ ভাষা-উপভাষা নিয়ে যে আলোচনা হল সবটাই কথ্য উপভাষা অর্থাৎ মানুষের মৌখিক ভাষা নিয়ে। এবার সাহিত্যের ভাষা প্রসঙ্গে আসা যাক। সাহিত্য রচনার ভাষা দু’রকমের হতে পারে- ১) পদ্য, ২)গদ্য। বাংলা সাহিত্যের সূচনাপর্ব থেকে মধ্যযুগের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত যা কিছু সাহিত্য রচিত হয়েছে তার প্রায় সবটাই হল পদ্য সাহিত্য। বাংলা গদ্য সাহিত্যের পথচলা শুরু হয়েছে অনেক পরে। উনিশ শতকের শুরুতেই বাংলা গদ্য রচনা শুরু হয়।

সেই হিসেবে বাংলা গদ্যের বয়স দুশো বছরের কিছুটা বেশি। প্রথমদিকে যেসকল লেখক গদ্য রচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন তাদের রচনায় সংস্কৃত শব্দের আধিক্য ছিল। সেই ভাষাকে ‘সাধু ভাষা’ নামে অভিহিত করা হয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখদের রচনার ভাষা ছিল এই সাধু ভাষা। বিশ শতকের প্রথম দশক থেকেই সাধারণ কথ্য ভাষায় বা মানুষের মুখের ভাষায় সাহিত্য রচনা শুরু হয়। এই ভাষারীতির নাম দেওয়া হয় চলিত ভাষা।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, বাংলা সাহিত্যিক উপভাষা দুটি। যথা- পদ্য ও গদ্য। গদ্য ভাষা আবার সাধু এবং চলিত- এই দুই ভাগে বিভক্ত।

সাধু এবং চলিত ভাষার পার্থক্য

প্রথমত, সাধু ভাষায় তৎসম শব্দের প্রাধান্য বেশি। অপরপক্ষে, চলিত ভাষায় তদ্ভব, দেশী ও বিদেশি শব্দের প্রাধান্য বেশি। তীয়ত, সাধু ভাষায় ক্রিয়াপদের পূর্ণরূপ ব্যবহার করা হয়। যেমন- করিতেছিলাম, গিয়েছিলাম, যাইতেছেন ইত্যাদি। পক্ষান্তরে, চলিত ভাষায় ক্রিয়াপদের সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহার করা হয়। যেমন- করছিলাম, গেছিলাম, যাচ্ছেন ইত্যাদি।

তৃতীয়ত, সাধু ভাষায় সর্বনাম পদের পূর্ণ রূপটি ব্যবহার করা হয়। যেমন- তাহার, তাহাদিগের, তাহাদিগকে, যাহা, তাহা ইত্যাদি। অপরপক্ষে, চলিত ভাষায় সর্বনামের সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহার করা হয়। যেমন- তার, তাদের, তাদেরকে, যা, তা ইত্যাদি। চতুর্থত, সাধু ভাষায় তৎসম অনুসর্গগুলির ব্যবহার করা হয়। যেমন- কর্তৃক, দ্বারা, নিমিত্ত ইত্যাদি। চলিত ভাষায় তৎসম অনুসর্গের পাশাপাশি তদ্ভব রূপগুলিও ব্যবহৃত হয়। যেমন- দিয়ে, জন্যে, থেকে ইত্যাদি।

পঞ্চমত, সাধু বাংলায় সংস্কৃত অব্যয়গুলি অবিকৃতভাবে ব্যবহৃত হয়। যেমন- যদ্যপি, তথাপি, বরঞ্চ ইত্যাদি। চলিত ভাষায় সংস্কৃত অব্যয়গুলির ঈষৎ পরিবর্তিত তদ্ভব রূপটি ব্যবহৃত হয়।

ষষ্ঠত, সাধু ভাষায় সমাসবদ্ধ-সন্ধিবদ্ধ পদের ব্যবহার বেশি। চলিত ভাষায় সমাসবদ্ধ- সন্ধিবদ্ধ পদ অনেক কম ব্যবহৃত হয়।

সাধু থেকে চলিত ভাষায় রূপান্তর

সাধু গদ্য- “সকলে আম্র খাইতে জানে না। সদ্য গাছ হইতে পাড়িয়া এ ফল খাইতে নাই। ইহা কিয়ৎক্ষণ সেলাম-জলে ফেলিয়া ঠাণ্ডা করিও- যদি জোটে, তবে সে জলে একটু খােসামােদ বরফ দিও- বড় শীতল হইবে। তারপরে ছুরি চালাইয়া স্বচ্ছন্দে খাইতে পার।” -কমলাকান্ত, বঙ্কিমচন্দ্র

চলিত গদ্য- সবাই আম খেতে জানে না। টাটকা-টাটকা গাছ থেকে পেড়ে এ ফল খেতে নেই। একে কিছুক্ষণ সেলাম-জলে ফেলে ঠাণ্ডা করাে- যদি জোটে, তবে সে জলে একটু খােসামােদ বরফ দিও- বেশ ঠাণ্ডা হবে। তারপরে ছুরি চালিয়ে ইচ্ছামতাে খেতে পারাে।

সাধু গদ্য- “এক লৌহদন্ড তাঁহার চির-সহচর ছিল; উহা হস্তে না করিয়া তিনি কখনও বাটীর বাহির হইতেন না। তৎকালে পথে অতিশয় দসভয় ছিল। স্থানান্তরে যাইতে হইলে অতিশয় সাবধান হইতে হইত।”-বিদ্যাসাগর চরিত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

চলিত গদ্য- একটা লােহার ডান্ডা তাঁর সব সময়ের সঙ্গী ছিল ; ওটা হাতে না করে তিনি কখনাে বাড়ির বার হতেন না। সেকালে রাস্তায় খুব ডাকাতের ভয় ছিল। জায়গায় যেতে হলে খুব হুঁশিয়ার হতে হতাে।

যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে।

এগুলো দেখুন

কলকাতা-দিল্লির টর্চার সেলের সন্ধান দিল র‌্যাব

কলকাতা-দিল্লির টর্চার সেলের সন্ধান দিল র‌্যাব

কলকাতা-দিল্লির টর্চার সেলের সন্ধান দিল র‌্যাব স্টাফ রিপোর্টার :: ইউরোপ-অষ্ট্রেলিয়ার পাঠানোর কথা বলে দেশের বিভিন্ন …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *