অভিবাসন কী, অভিবাসী শ্রমিক ও অভিবাসনের গুরুত্ব

জেনে নিন অভিবাসন কী, অভিবাসী শ্রমিক ও অভিবাসনের গুরুত্ব সম্পর্কে। আসুন আজকে এ সম্পর্কে আলোচনা করে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।  তাহলে চলুন আজকে আলোচনা শুরু করা যাক।



অভিবাসন

সাধারণত অভিবাসন বলতে আমরা বুঝি কাজ বা নতুন আবাস গড়ে তোলার জন্য মানুষের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া।

শ্রম অভিবাসন

যখন একজন ব্যক্তি কাজ করবার উদ্দেশ্যে তার নিজ দেশের সীমানা অতিক্রম করে অন্য দেশে গমন করে, তখন তাকে আন্তর্জাতিক শ্রম অভিবাসন বলে। শ্রম অভিবাসী সাধারণত নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চুক্তিভিত্তিক বিদেশে যান এবং মেয়াদ শেষে নিজ দেশে ফিরে আসেন।

নিয়মিত অভিবাসী শ্রমিক

নিয়মিত অভিবাসী শ্রমিক সেই ব্যক্তি, যে অভিবাসন দেশের সরকারের অনুমতি বা ভিসা (Visa) নিয়ে নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পাদন করার জন্য বিদেশে যান।

অনিয়মিত অভিবাসী শ্রমিক

অনুমতি না নিয়ে যারা কাজের উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করেন তাদের অনিয়মিত অভিবাসী শ্রমিক বলা হয়। তারা প্রায়শই অসুবিধাজনক অবস্থায় কাজ করে এবং গ্রহণকারী বা প্রেরণকারী দেশের সহায়তা থেকে বঞ্চিত হন।

অভিবাসী শ্রমিক কে?

জাতিসংঘের সকল অভিবাসী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যের অধিকার সংরক্ষণ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশন, ১৯৯০ (International Convention on the Protection of the Rights of All Migrant Workers and Members of their Families, 1990) অনুযায়ী- “অভিবাসী শ্রমিক সেই ব্যক্তি, যিনি কোনো একটি দেশে মজুরির বিনিময়ে কাজে (শ্রমে) নিয়োজিত হবার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন, নিয়োজিত আছেন কিংবা নিয়োজিত ছিলেন, কিন্তু তিনি সেই দেশের নাগরিক নন”।

জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী- “যখন এক দেশ থেকে কাজের উদ্দেশ্যে বা অর্থ উপার্জনের জন্য মানুষ আরেক দেশে যায়, তখন তাকে অভিবাসী কর্মী বলে”।

অভিবাসন কী, অভিবাসী শ্রমিক ও অভিবাসনের গুরুত্ব

অভিবাসনের মাধ্যম

অনুমোদিত এজেন্সি

সব দেশেই শ্রম রপ্তানির জন্য বিশেষ এজেন্সি প্রতিষ্ঠা করা হয় বা এই কাজে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেয়া হয়। বাংলাদেশেও এমন রিক্রুটিং এজেন্সি (Recruiting Agency) আছে। বাংলাদেশে ১১০০- এর অধিক সরকার কর্তৃক অনুমোদিত রিক্রুটিং এজেন্সি আছে যারা বিদেশে লোক পাঠিয়ে থাকে। সরকার কর্তৃক অনুমোদিত এজেন্সির মাধ্যমে কর্মের উদ্দেশ্যে বিদেশ গমন নিরাপদ।

স্থানীয় দালাল ও সামাজিক নেটওয়ার্ক

অভিবাসীদের একটা বড়ো অংশ স্থানীয় দালাল এবং সামাজিক নেটওয়ার্কের মধ্য দিয়ে অভিবাসন করে থাকে। দালালের মাধ্যমে অভিবাসন করতে গিয়ে অনেক বাংলাদেশিই প্রতারণার শিকার হন।

সামাজিক নেটওয়ার্ক বলতে বোঝায় বিদেশে কর্মরত আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী এবং পরিচিতদের বোঝানো হয়। সামাজিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অভিবাসন নেহায়েত কম নয়, তবে স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের জন্য বিদেশ যাওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ; বেশিরভাগ সময়েই বিপদে পড়তে হয়, জীবনও হারাতে হয় অনেক অভিবাসীর। স্থানীয় দালালরা বেশিরভাগই অবৈধভাবে অভিবাসন করে থাকেন।

অভিবাসন কী, অভিবাসী শ্রমিক ও অভিবাসনের গুরুত্ব

অভিবাসন ও নারী অভিবাসনের গুরুত্ব ও অবদান

সারা বিশ্বেই অভিবাসন হয় আন্তর্জাতিক অভিবাসনের অনেক কারণ আছে। অভিবাসনের মূল উদ্দেশ্য জীবনমান উন্নয়ন। বিশ্বের অন্যতম প্রথম ১০ টি অভিবাসী প্রেরণকারী দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ।

সরকারি সূত্রমতে গত ৪০ বছরে বাংলাদেশ থেকে নিয়মিত পথে অভিবাসী হয়েছে ১ কোটিরও বেশি কর্মী, যাদের মূল গন্তব্যদেশ মধ্যপ্রাচ্য হলেও অভিবাসন একদিকে যেমন অর্থ আনে, দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করে, বেকারত্ব কমায় তেমনি অভিবাসী কর্মীর পরিবারের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। এর ফলে অভিবাসীর পরিবারের শিক্ষার উন্নয়ন হয় এবং সার্বিকভাবে জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করে। অভিবাসনের ফলে দক্ষ জনশক্তিরও বিকাশ ঘটে।

নারী অভিবাসী কর্মীগণও পুরুষদের মতো সমান হারে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন। তাদের উপার্জিত অর্থ তার পরিবারের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সার্বিকভাবে নারীর উন্নয়নে অবদান রাখছে, যদিও নারী অভিবাসীদের পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়।

নারী অভিবাসন একদিকে যেমন নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে, অন্যদিকে তা নারীর ক্ষমতায়ন ও মানবিক বিকাশে সহায়তা করে। যদিও বাংলাদেশ থেকে যেসব নারী এতোদিন অভিবাসী হয়েছেন, তাদের শতকরা নব্বই ভাগেরও বেশি স্বল্পদক্ষ ও গৃহকর্মী পেশায় কাজ করছেন, যেন তারা বিভিন্নভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার মুখোমুখি হয়েছেন। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও এই স্বল্পদক্ষ নারী কর্মীগণ দেশে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন, তাদের পাঠানো অর্থে সন্তানদের উন্নয়ন হচ্ছে।

গৃহকর্মী ছাড়াও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক নারী কর্মী অন্যান্য পেশায় অভিবাসী হচ্ছেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো ক্সতরি পোশাক শিল্পে বেশ কয়েকটি দেশে নারীর অংশগ্রহণ, পাশাপাশি গৃহকর্মী পেশায়ও কিছু নারী কর্মী বিদেশে কাজ করছেন। তবে নারী কর্মীদের ক্সতরি পোশাক শিল্প, গৃহকর্মী এবং আরও কিছু অর্ধ-দক্ষ (semi-skilled) পেশায় অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়ছে। এই সুযোগ মধ্যপ্রাচ্য ছাড়িয়ে নতুন কিছু কিছু নতুন শ্রম-বাজারে তথা- হংকং, জাপান, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সুযোগ সৃষ্টি করছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, অভিবাসনে আমাদের থেকে এগিয়ে থাকা কয়েকটি দেশ হলো ফিলিপাইন, শ্রীলংকা- যেসব দেশ থেকে নারী ও পুরুষ অভিবাসনের হার প্রায় সমান।

বাংলাদেশ যদি যথাযথ পরিকল্পনা করে এগোতে পারে, তবে বাংলাদেশ থেকেও বিপুল সংখ্যক নারী কর্মী বিভিন্ন পেশায় এসব দেশে অভিবাসী হয়ে নিজেদের উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের উন্নয়ন করতে পারবে।

সার্থক শ্রম অভিবাসন সম্পর্কে ধারণা

অভিবাসনের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে ব্যক্তির আর্থ-সামাজিক অবস্থার ও জীবনযাত্রার

মানের উন্নয়ন সাধন করা। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য যা যা করতে হবে:

  • যে কাজ নিয়ে বিদেশে যাচ্ছে সেই কাজের প্রকৃতি ও ধরন সম্পর্কে গন্তব্য দেশে যাওয়ার পূর্বে যথাযথ ধারণা থাকা প্রয়োজন এবং একই সাথে এই কাজের প্রতি আগ্রহ থাকা দরকার।
  • গন্তব্য দেশে পৌঁছানোর পর দক্ষতার সাথে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযতভাবে পালন করতে হবে।
  • নিজের দক্ষতাকে শাণিত এবং বৃদ্ধি করতে হবে।
  • চাকরিদাতার সাথে ভালো সম্পর্ক ক্সতরি করতে হবে।
  • চাকরিদাতার সাথে যথাযথ আচার-আচরণ প্রদর্শন করতে হবে।
  • গন্তব্য দেশের আইন-শৃঙ্খলা ও সংস্কৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে এবং মেনে চলতে হবে।
  • গন্তব্য দেশে অপরাধমূলক, অবৈধ ও অসামাজিক কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত হওয়া যাবে না।
  • অর্জিত টাকা যথাযথভাবে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ করতে হবে।
  • প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন করে অভিবাসন করতে হবে। বিদেশের শ্রমবাজারে বাংলাদেশি কর্মীর বিশেষ চাহিদা থাকায় বাংলাদেশের মত দেশ থেকে বিদেশে চাকরি নিয়ে অনেক শ্রমিক অভিবাসন করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা অতি সামান্য যোগ্যতা বা দক্ষতা অর্জন করে অথবা একেবারেই অদক্ষ হয়ে অভিবাসন করছে। দক্ষতার অভাবে এবং অজ্ঞতার কারণে তারা অপব্যবহার ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। একটু সচেতন হলেই এই অপব্যবহারগুলো রোধ করা সম্ভব। অধিক দক্ষতা ও প্রস্তুতি তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করবে এবং যেকোনো মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অপব্যবহারের বিরুদ্ধে লড়তে তাদের সাহসী করবে।

সার্থক শ্রম অভিবাসনের ক্ষেত্রে বাধা বা প্রতিবন্ধকতা

সার্থক শ্রম অভিবাসনের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়াবলীকে বিভিন্ন গবেষণাতে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে:

  • অতিরিক্ত অভিবাসনের খরচ, অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ এবং ভাষাগত দক্ষতার অভাব;
  • গন্তব্য দেশের বিমানবন্দর থেকে পালিয়ে যাওয়া;
  • চাকরিদাতার ঘর থেকে পালিয়ে যাওয়া;
  • গৃহপীড়া;
  • যৌনবাহিত রোগ ও গর্ভধারণ সম্পর্কিত তথ্যাদি গোপন করা;
  • কাজের প্রতি অনীহা, অসচেতনতা ও অবজ্ঞা;
  • গন্তব্য দেশে অপরাধমূলক, অবৈধ ও অসামাজিক কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হওয়া;
  • চাকরিদাতার প্রতি যথাযথ আচার আচরণ প্রদর্শন না করা;
  • পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন না থাকা


অভিবাসনের পূর্বে বাংলাদেশি শ্রমিকদের সর্বোপরি মনে রাখতে হবে

বাংলাদেশ সরকার অভিবাসনে আগ্রহী বাংলাদেশি শ্রমিকদের সর্বোপরি নিম্নলিখিত বিষয় মেনে চলতে অনুরোধ জানায়:

  • অভিবাসনের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ঋণ সহায়তা নিন।
  • প্রতারক ও অসাদু দালালের খপ্পরে পড়ে অতিরিক্ত খরচে বিদেশে আসবেন না।
  • আপনার নাম ন্যাশনাল ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্ত করুন। ইউনিয়ন তথ্য সেবাকেন্দ্রের সাহায্য নিন।
  • বিদেশ যাওয়ার পূর্বে দরকারী প্রশিক্ষণ নিন।
  • আপনার চাকরি/ কাজের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে ভালভাবে জেনে শুনে বিদেশে আসুন।
  • সরকার নির্ধারিত এজেন্সি অথবা বোয়েসেলের মাধ্যমে বৈধ পথে বিদেশে আসুন।
  • আরবী ও ইংরেজি ভাষায় ভাব প্রকাশের জন্য কয়েকটি সাধারণ বাক্য শিখে নিন।
  • বিদেশে আসার জন্য প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিএমইটি, জেলা কর্মসংস্থান অফিসে যোগযোগ করে দরকারী তথ্য জেনে নিন।
  • বিদেশে আসার পূর্বে আত্মীয়-স্বজনদের টেলিফোন নাম্বার সাথে রাখুন।
  • মনে রাখবেন মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও অন্য যে সকল দেশে
  • যে সব দেশে বাংলাদেশি শ্রমিকগণ যান সে সব দেশে কোনো ফ্রি ভিসা ইস্যু করা হয় না।

উপর্যোক্ত তথ্য জনস্বার্থে প্রচার করা হলো। অভিবাসন বা শ্রম অভিবাসন সম্পর্কে যেকোনো তথ্যের জন্য প্রবাসী কল্যান মন্ত্রণালয়, বিএমইটি এবং জেলা কর্মসংস্থান কার্যালয়ে যোগাযোগ করুন।

যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন। এবং আমাদের সাথে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে।

এগুলো দেখুন

সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাত্রায় শীর্ষে বাংলাদেশিরা

সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাত্রায় শীর্ষে বাংলাদেশিরা । আসুন আরো বিস্তারিত জেনে নিন নৌযানডুবিতে ঘটছে প্রাণহানি। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *