ফিরোজ মাহমুদ।। শবে বরাত বা মধ্য শাবানের রজনী নিয়ে এই উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ করা যায়। এ রাতের ফজিলতের মহাগুরুত্ব নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা আছে। তবে কোরআন-সুন্নাহর সঠিক জ্ঞানই এই পথ থেকে আমাদের মুক্তি দিতে পারে। আর এতে মুসলিম উম্মাহর বিভাজনের রেখা অনেকাংশেই মিটে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মাঝেমধ্যে দেখা যায়, সঠিক কোনো প্রমাণ না থাকলেও ইবাদতের শুরুতে মুসলিম সমাজে বিদয়াত চালু হয়েছে ব্যক্তিবিশেষের দোহাই দিয়ে। উদাহরণস্বরূপ কাউকে যদি বলা হয়, কেন তুমি এভাবে জিকর বা ইবাদত করছ? সে সঙ্গে সঙ্গে বলবে, অমুক অলি, অমুক পীরসাহেব, অমুক আলিম বা অমুক আকাবের করেছেন, তাই করি।
সে এ কথা বলে না যে, আল্লাহ বলেছেন তাই করি, রাসুল (সা.) বলেছেন, করেছেন বা সম্মতি দিয়েছেন, তাই করি বা অমুক সাহাবি করেছেন, তাই করি। সত্যিই এটি মহাপরিতাপের বিষয়। এমনিভাবে মধ্য শাবানের রজনীকে (শবে বরাত) নিয়ে আমাদের সমাজে প্রচলিত কিছু আমল মুরুব্বিদের দোহাই দিয়ে চলছে, যাতে কোরআন ও সহিহ সুন্নাহর কোনো দলিল খুঁজে পাওয়া যায় না। এখন শবে বরাত শব্দের বিশ্লেষণের দিকে যদি আমরা লক্ষ করি দেখব, ‘শব’ শব্দটি ফারসি, যার অর্থ রাত আর ‘বরাত’ শব্দটি আরবি ‘বারাআত’ শব্দ থেকে গৃহীত, যার অর্থ বিমুক্তকরণ, সম্পর্ক ছিন্ন করা, নির্দোষ প্রমাণিত হওয়া ইত্যাদি। সুতরাং শবে বরাত অর্থ বিমুক্তকরণ রজনী। যদিও আমাদের দেশে শবে বরাত অর্থ ভাগ্য রজনী। হাদিসে উল্লিখিত ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ই ভারতীয় উপমহাদেশে শবে বরাত বলে পরিচিত। এখন আল কোরআনের আলোকে ‘শবে বরাত’-এর অনুসন্ধান করলে দেখব, কোরআনের কোথাও শবে বরাত বা মধ্য শাবনের রজনী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উল্লেখ নেই।
কিন্তু অতিরঞ্জিতকারীরা আল কোরআনের সুরা দোখানের ৩ নম্বর আয়াত দিয়ে শবে বরাত প্রমাণের ব্যর্থ প্রয়াস চালান। আয়াতটি হলো, ‘ইন্না আনজালনাহু ফি লাইলাতিম মোবারাকাতিন ইন্না কুন্না মুনজিরিন’, অর্থ : নিশ্চয়ই আমি এটি (আল কোরআন) এক বরকত ও কল্যাণময় রাতে নাজিল করেছি। নিশ্চয়ই আমি তো (জাহান্নাম থেকে) সতর্ককারী। অধিকাংশ আলিম বলেছেন, ‘লাইলাতুম মোবারাকাহ’ হলো ‘লাইলাতুল কদর’। কেউ কেউ বলেছেন, তা হলো মধ্য শাবানের রজনী। তবে এ মতটি কোরআনের দলিল দ্বারাই বাতিল হয়ে যায়। কারণ, মহান রাব্বুল আলামিন মহাগ্রন্থ আল কোরআনের সুরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে বলেন, রামাদান মাস, যার মধ্যে আল কোরআন নাজিল করা হয়েছে, যা মানবজাতির জন্য পুরোপুরি হিদায়াত।এই আয়াতটি দ্ব্যর্থহীনভাবে জানাচ্ছে যে, কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময় রামাদান মাস আর সুরা দোখানের এই আয়াতে কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময় জানিয়ে বলা হয়েছে, ‘লাইলাতুম মোবারাকাহ’। কাজেই কেউ যদি মনে করে যে, এই লাইলাতুম মোবারাকাহ হলো রামাদান ছাড়া অন্য মাসে, তাহলে সে আল্লাহর নামে তাহা ডাহা মিথ্যা বানিয়ে বলল। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বিখ্যাত তাফসিরকারক আল্লামা কুরতুবি (র.) বলেন, ‘লাইলাতুম মোবারাকাহ হলো লাইলাতুল কদর।’ আল্লামা ইবনে কাসির (র.) বলেন, ইকরিমা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে বরকতময় রাতটি শাবানের মধ্যম রজনী। এ মতটি একটি অসম্ভব ও অবাস্তব মত। কারণ, কোরআনে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা হয়েছে যে, এ রাতটি রামাদানের মধ্যে।
আল্লামা আশরাফ আলী থানবী (র.) বলেন, অধিকাংশ তাফসিরকারকই ‘লাইলাতুম মোবারাকাহ’কে লাইলাতুল কদর বলে তাফসির করেছেন এবং এ সম্বন্ধে হাদিসও যথেষ্ট রয়েছে। আর কেহ কেহ ‘লাইলাতুম মোবারাকাহ’র তাফসির করেছেন শবে বরাত। যেহেতু শবে বরাতে কোরআন নাজিল হয়েছে বলে কোনো রেওয়ায়াত নেই এবং শবে কদরে নাজিল হয়েছে বলে আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে, সেহেতু শবে বরাত বলে লাইলাতুম মোবারাকাহ-এর তাফসির করা শুদ্ধ নয় বলে মনে হয়। অন্যদিকে, হাদিস জগতের সবচেয়ে বিশুদ্ধতম গ্রন্থ বুখারি ও মুসলিম-এ লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান নিয়ে কোনো হাদিস পাওয়া যায় না। তবে সিহাহ সিত্তার অন্যান্য গ্রন্থে এ সম্পর্কে একাধিক হাদিস পাওয়া যায়। যেমন—ইবনে মাজাহর ১৩৮৮ নম্বর হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, যখন মধ্য শাবানের রজনী আসে, তখন তোমরা রাতে দণ্ডায়মান থাকো এবং দিবসে সিয়াম পালন করো। কারণ, ওই দিন সূর্যাস্তের পর মহান আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন, কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। কোনো রিজিক তালাশকারী আছে কি? আমি তাকে রিজিক প্রদান করব। কোনো দুর্দশাগ্রস্ত ব্যক্তি আছে কি? আমি তাকে মুক্ত করব। এভাবে সুবহে সাদিক উদয় পর্যন্ত চলতে থাকে। হাদিসের ইমামদের মত অনুযায়ী, এই হাদিস অত্যন্ত দুর্বল।কিন্তু বুখারি ও মুসলিম-এ এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমাদের প্রতিপালক প্রতি রাতের শেষ এক-তৃতীয়াংশ বাকি থাকতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করে বলেন, আমাকে ডাকার কেউ আছে কি?
আমি তার ডাকে সাড়া দেব। আমার কাছে চাওয়ার কেউ আছে কি? আমি তাকে তা প্রদান করব। আমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার কেউ আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। বুখারি ও মুসলিমের এই হাদিস দ্বারা বোঝা যাচ্ছে যে, মুমিনের প্রতি রাতই ফজিলতপূর্ণ। অনুরূপভাবে সিহাহ সিত্তার অন্যতম হাদিসগ্রন্থ তিরমিজি শরিফে উল্লেখ রয়েছে, হজরত আয়েশা সিদ্দিকা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক রাতে আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) খুঁজে পেলাম না। তখন বের হয়ে দেখি, তিনি জান্নাতুল বাকিতে আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে রয়েছেন। তিনি বললেন, তুমি কি আশঙ্কা করছিলে যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল তোমার ওপর অবিচার করবেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), আমি ধারণা করেছিলাম যে আপনি আপনার অন্য কোনো স্ত্রীর নিকট গমন করছেন।
অতঃপর তিনি বলেন, নিশ্চয়ই মহিমান্বিত পরাক্রান্ত আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। অতঃপর তিনি ‘কালব গোত্রের মেষপালের পশমের অধিক সংখ্যককে ক্ষমা করেন।’ ইমাম বুখারি (রা.) ওই হাদিসটিকে দুর্বল বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার পরও এ হাদিসে প্রিয় নবীর এ রাতের ইবাদতের যে পদ্ধতি জানা যায়, তা থেকে আমরা অনেক দূরে সরে এসেছি। প্রিয় নবী (সা.) এই রাতে ইবাদত করেছেন, তাঁর সহধর্মিণী পর্যন্ত জানেন না। তাহলে বোঝা গেল, এ রাতে কেউ যদি ইবাদত করতে চায়, তাহলে তা করতে হবে ব্যক্তিগত, একাকী, নির্জনে, নিরিবিলি পরিবেশে।
এ রাতের বিষয়ে চার ইমামের ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া যায়। যেমন—ইমাম মালেক (র.) ও তাঁর অনুসারী ফকিহ ও ইমামগণ ওই রাতে বিশেষ ইবাদত পালন করতে নিষেধ করেছেন। ইমাম শাফেয়ী (র.)-এর মতে, এ রাতে ব্যক্তিগতভাবে একাকী নিজ গৃহের মধ্যে ইবাদত ও দোয়া মোনাজাতে থাকা মুস্তাহাব। ইমাম আবু হানিফা (র.) ও ইমাম আহমদ (র.) এ বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট মত ব্যক্ত করেননি। একটি প্রশ্ন রাখতে চাই আলেমদের কাছে, তা হলো, একশ শবে বরাতের আমল একটি ফরজের সমান হবে কি? উত্তর আসবে, অবশ্যই না। তাহলে আসুন, এ রাতের ফজিলত ও মর্যাদা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করে ব্যক্তিগতভাবে একাকী নিজ গৃহে ইবাদতের ক্ষেত্রে কাউকে কটাক্ষ না করে, মুসলিম মিল্লাতকে ঐক্যের পথে পরিচালিত করি। শবে বরাতের নামাজ ও রোজাঃ শবে বরাতের আলাদা কোনো নামাজ বা রোজা নেই।এই রাতে নামাজ আদায়ের আলাদা কোনো পদ্ধতিও নেই। তবে সালাফদের কেউ কেউ এ রাতে নফল ইবাদাত করেছেন।তাই এই রাতে কেউ যদি নফল সালাত আদায় করে তাতে কোনো অসুবিধা নেই।তবে এসব একাকী করাই উত্তম।
আর মধ্য শাবানের দিনে রোজা রাখার আলাদা কোনো বিধান ইসলামে নেই। তবে কেউ যদি ‘আইয়্যামে বীদ’ অর্থাৎ ১৩,১৪ ও ১৫ তারিখ রোজা রাখেন তাতে কোনো অসুবিধা নেই। কারণ আল্লাহর রাসূল (সা) প্রত্যেক মাসের এই ৩দিন রোজা রাখতেন। তবে মনে রাখা দরকার, ফরজ সালাত ও ইবাদাত বাদ দিয়ে নফল আদায়ে কোনো স্বার্থকতা ও সফলতা নেই।তাই যারা ফরজ সালাত ও ইবাদাতের প্রতি উদাসীন তাদের নফল ইবাদাত মূল্যহীন।আর যারা ফরজ সালাত ও ইবাদাতের প্রতি যত্নশীল তারা এই রাতে ঘুমিয়ে থাকলে ও সাওয়াব পাবেন। করণীয়ঃ যাদের প্রাত্যহিক বা প্রায়ই রাত জেগে ইবাদাতের অভ্যাস আছে তারা অন্যদিনের মতো এই রাতও ইবাদাতে কাটাতে পারেন তাতে কোনো অসুবিধা নেই।তবে এসব ইবাদাত একাকি করাই উত্তম।মনে রাখা দরকার, কেউ যদি শবে বরাতের নামাজ নামে আলাদা কোনো নামাজ এই রাতে আদায় করে তাহলে তা হবে বাড়াবাড়ি ও সুস্পষ্ট সীমালংঘন।
সন্দেহ নেই এই রাত ফজিলতপূর্ণ,তবে এটাও সত্য এই রাতের আলাদা কোনো নামাজ রাসূল (সা) বা তার সাহাবাগণ কখনো আদায় করেন নি। মোটকথা হলো,অভ্যাসগত কারণে এই রাতে নফল ইবাদাত করায় কোনো বাধা নেই। বর্জনীয়ঃ শবে বরাতকে কেন্দ্র করে নিম্নে উল্লেখিত প্রত্যেকটি কাজ অবশ্যই বর্জনীয়ঃ শিরকে লিপ্ত হওয়া। হিংসাত্মক কাজ করা। আল্লাহর নাফরমানীমূলক কাজ করা। সমবেত হয়ে ইবাদাত বন্দেগী করা। মসজিদ,মাজার ও কবরস্থান আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা। এ রাতে মৃত ব্যক্তির আত্মা তার গৃহে ফিরে আসে এমন ধারণা করা। আতশবাজি ফোটানো।
রাতে ইবাদাতের উদ্দেশ্যে সন্ধ্যায় গোসল করাকে ফজীলতপূর্ণ মনে করা। এ রাতের জন্য আলাদা খাবার তৈরি করা, বিশেষ করে হালুয়া-রুটি পাকানো। এ রাতকে খাওয়া দাওয়া ও উৎসবের রাতে পরিণত করা। এ রাতকে ভাগ্য রজনী মনে করা। পরিশেষে বলবো,ফরজ ও নফলের সীমারেখা অনুধাবন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।সারাজীবনের নফল ইবাদত একটি ফরজ ইবাদতের সমান হবে না।নফলের পেছনে দৌড়ে আমরা মাঝে মাঝে ফরজ সালাতগুলোকেও তরক করে ফেলি।এর চেয়ে কঠিন আত্মপ্রবঞ্চনা আর কিছুই হতে পারে না। মহান আল্লাহ বান্দাদের প্রতি একটি বিশেষ অনুগ্রহ করেছেন,আর তা হলো- তিনি তার বান্দাদের ইবাদত-বন্দেগীতে কোনো ত্রুটি হলে তার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। যেমনঃ নফল সালাত দ্বারা ফরজ সালাত আদায়ে ভুল-ত্রুটিগুলো পুষিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করেছেন।তাই ফরজগুলো যথাযথ আদায় করে এরপর সুন্নাত ও নফল আদায় করলেই সুফল পাওয়া যাবে।আর সমস্ত ইবাদাত হবে আল্লাহ ও রাসূল (সা) এর নির্দেশিত পন্থায়।মনগড়া কোনো ইবাদাত শরীয়তে গ্রহণযোগ্য নয়। লেখক: মাদ্রাসা শিক্ষক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।