পলিথিন থেকে জ্বালানি তেল উৎপাদনের গল্প

যারা উদ্যোগ হতে চান তাদের জন্য পলিথিন থেকে জ্বালানি তেল উৎপাদনের গল্প । তাঁর কথায় ঘুরে ফিরে এল ওই একটি শব্দই পলিথিন। কখনো এর আগে বিশেষণ হিসেবে যোগ হয় ‘পরিত্যক্ত’, ‘পুনর্ব্যবহার্য’ ইত্যাদি শব্দ। পরিচয়ের শুরুতেই তৌহিদুল ইসলাম পায়ের কাছে পড়ে থাকা বিস্কুটের মোড়ক দেখিয়ে যেমন বলছিলেন, এই যে পলিথিনটি দেখছেন, এর ওজনের ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ জ্বালানি উৎপাদন করা সম্ভব।

সেটার পাশেই পড়েছিল পলিথিনের ব্যাগ। বেকারি পণ্যের সম্ভবত। বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে বেশ খানিকটা পরিষ্কার মনে হচ্ছিল। তাহলে এই ব্যাগ থেকে কতটুকু জ্বালানি তেল উৎপাদন সম্ভব? ‘ওজনের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ, কারণ এর মান বিস্কুটের মোড়কের চেয়ে ভালো।’ ফেলে দেয়া এমন পলিথিন নিয়েই দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন তৌহিদুল। জামালপুরের তরুণ তৌহিদুল ইসলাম পরিত্যক্ত পলিথিন ব্যবহার করে জ্বালানি তেল তৈরি করেন। বিষয়টি যে একেবারে আনকোরা তা নয়, অনেক দেশেই এমন উদাহরণ আছে। তবে আমাদের দেশে পলিথিনের বর্জ্য থেকে জ্বালানি তৈরির ঘটনা নতুনই।


আরো পড়ুন: দেশে আস্থার অপর নাম সঞ্চয়পত্র
আরো পড়ুন: বাড়ি তৈরিতে ২ কোটি টাকা লোন দিচ্ছে ডাচ বাংলা ব্যাংক
আরো পড়ুন: ধান কেনা বেচার লাভজনক ব্যবসার কৌশল


শুধু তেল নয়, তৌহিদুল মিথেন গ্যাস ও ছাপার কাজে ব্যবহারের জন্য কালিও পেয়ে যান ওই একই পলিথিন ব্যবহার করে। ২৫ বছর বয়সী তৌহিদুল ইসলাম এ কাজের জন্য স্বীকৃতিও পেয়েছেন দেশে-বিদেশে। পরিবেশবিষয়ক গবেষণা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন বিভাগে চলতি বছরের জাতীয় পরিবেশ পদক বিগত ২০১৮ পাচ্ছেন তৌহিদুল। ১৮ জুলাই পরিবেশ অধিদপ্তরের এ পুরস্কার প্রদান করা হবে।

জামালপুর শহরের পৌরসভার বর্জ্য শোধনাগারের পাশে ছোট একটি প্ল্যান্ট নির্মাণ করেছেন তৌহিদুল ইসলাম। সেখান থেকে পরীক্ষামূলকভাবে ১০৫ লিটার তেল, ১৫ থেকে ২০ লিটার এলপি গ্যাস এবং কয়েক লিটার ছাপার কালি উৎপাদন করা হয়েছে। ১০০ কেজি পলিথিন থেকে ৭০ লিটার জ্বালানি তেল, ১০ লিটার মিথেন গ্যাস ও ২০ লিটার ছাপার কালি উৎপাদন সম্ভব বলে মনে করেন তৌহিদুল ইসলাম।

কিন্তু এত কিছু থাকতে পরিত্যক্ত পলিথিনই কেন বেছে নিলেন? ‘সত্যি বলতে কি? আমি কিন্তু এত কিছু ভেবে করিনি। প্রথমে লক্ষ্য ছিল পরিবেশসম্মত উপায়ে পলিথিন ধ্বংস করা। সেটা করতে গিয়েই এই উদ্ভাবন।’ বললেন তৌহিদুল।

পলিথিন থেকে জ্বালানি তেল উৎপাদনের গল্প

পলিথিনের সাথে পরিচয়

জামালপুর সদর উপজেলার বেলটিয়া গ্রামে তৌহিদুলদের বাড়ি। বাড়ির এক কোনায় ফুলের বাগান করেছিলেন তাঁর মা হালিমা খাতুন। কিন্তু ফুলের গাছগুলো বড় হচ্ছিল না। কেন বড় হচ্ছে না? চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র তৌহিদুল এর কারণ খুঁজতে নামলেন। তিনি বের করলেন, গাছের শেকড়গুলো পলিথিনের ভেতর কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে। ফলে মাটিতে ছড়াতে পারছে না।

তৌহিদুল ইসলাম বললেন, ‘আমি শৈশবে একদম অন্য রকম ছিলাম। কোনো বিষয় নিয়ে ভাবতে, পড়ে থাকতেই ভালো লাগত। কোনও খেলনা হাতে পেলে, খেলার চেয়ে ভেঙে ভেতরটা দেখাতেই আগ্রহ থাকত। এ জন্য পাড়া-প্রতিবেশীরা আমাকে পাগল ভাবতেন, তাঁদের সন্তানদের মিশতে দিতেন না। তাই আমার কোনো বন্ধুবান্ধব ছিল না।’

সমস্যা তো পেলেন, কিন্তু এর সমাধান? এই পলিথিন বর্জ্যের বিকল্প ব্যবহারের উপায় খুঁজতে থাকেন তৌহিদুল ইসলাম। পুড়িয়ে ধ্বংস করা যায়। কিন্তু তাতে পরিবেশের ক্ষতি হয়। পলিথিন ধ্বংসের পরিবেশসম্মত উপায়ের খোঁজে লেগে থাকলেন তৌহিদুল।

বিগত ২০০৯ সাল। কয়েক বছর পড়াশোনা বন্ধ রেখে তখন উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র। রসায়ন বইয়ের পাতায় পাতায় মনোযোগ। জামালপুরের শহীদ জিয়াউর রহমান ডিগ্রি কলেজের রসায়ন বিভাগের প্রভাষক একরামুজ্জামানের কাছে যান নানা বিষয় নিয়ে জানতে। একরামুজ্জামান বলেন, ‘কোনও সমস্যায় পড়লেই তৌহিদুল আমার কাছে আসত। শুরুতে আমাদের বিজ্ঞান বিভাগের মাধ্যমেই ও কাজ শুরু করেছিল। ব্যবহারিক ক্লাসে এসে নানা বিষয় নিয়ে ওর ছিল প্রশ্ন। রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে পলিথিন থেকে কি উৎপন্ন হয় এ বিষয়গুলো নিয়ে জানতে চাইত। ল্যাবরেটরিতে কাজ করত। একসময় তো সফল হলো।’

পলিথিন যে একধরনের হাইটেমপারড হাইড্রোকার্বন এটা তিনি জেনে গেছেন। তখন নিজে নিজে এটি পরীক্ষা চালালেন। কাচের একটি নলের মধ্যে পলিথিন নিয়ে উচ্চ তাপে উত্তপ্ত করলেন। হঠাৎ পরীক্ষার নলটি বিস্ফোরিত হলো। এমন আরও কয়েকবার করলেন। সফলতা এল একবার। দেখতে পেলেন, প্রচণ্ড চাপে নল দিয়ে বাষ্প বের হচ্ছে। এরপর ঠান্ডা তরল হয়ে পানির মতো বোতলে জমা হচ্ছে তা। পরে দেখা গেল ওই তরল তেলের মতো কিছু একটা।

শুরুর গল্পটা এমনই ছিল। এর মধ্যে রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া সম্পর্কে আরো পড়াশোনা করতে থাকেন। বিগত ২০১১ সালে তিনি সফলভাবে প্রথম তেল উৎপাদন করতে পারেন। প্রথমে ইস্পাতের বড় আকারের একটি চেম্বারে (সিলিন্ডারের মতো দেখতে বস্তু) পলিথিন দিতে হয়। ওই প্রকোষ্ঠ হতে হবে বায়ুরোধী। চেম্বারটিকে উত্তপ্ত করার পর নলের মাধ্যমে কালচে রঙের তরল বস্তু, মিথেন গ্যাস ও কালি বের হচ্ছিল। পলিথিন পুড়িয়ে পাওয়া এই জ্বালানি নানা কাজে ব্যবহার করা যায়। প্ল্যান্টে উৎপাদিত তেল (পেট্রল) দিয়েই চলছে তাঁর নিজের মোটরসাইকেল।


আরো পড়ুন: মুখের ব্রণ-দাগ দূর করবে পুদিনা পাতা
আরো পড়ুন: ব্রণের দাগ দূর করে ফলের খোসা
আরো পড়ুন: মানসিক চাপ থেকে হতে পারে ত্বকের সমস্যা


উদ্ভাবনের জন্য বিগত ২০১০ সাল থেকে বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন তৌহিদুল। এর মধ্যে ২০১৭ সালে জামালপুর জেলা, ময়মনসিংহ বিভাগীয় ও জাতীয় পর্যায়ের সরকারের ‘ডিজিটাল মেলায়’ অংশ নিয়ে শ্রেষ্ঠ তরুণ উদ্ভাবকের পুরস্কার হিসেবে ৬ লাখ ২০ হাজার টাকা পান। বিগত ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্পের আওতায় আয়োজিত ‘উদ্ভাবকের খোঁজে বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করেন।

পুরস্কার হিসেবে তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে ৫ লাখ টাকা এবং প্ল্যান্ট নির্মাণের জন্য আরো ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। মে মাসে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ইনোভেনশন, ইনোভেশন অ্যান্ড টেকনোলজি প্রদর্শনীতে (আইটেক্স) অংশ নিয়ে পরিবেশ রক্ষা বিষয়ের উদ্ভাবনী কাজের জন্য স্বর্ণপদক পেয়েছেন। আবদুল মান্নান ও হালিমা খাতুনের ৩ ছেলে ও ১ মেয়ের মধ্যে সবার ছোট তৌহিদুল। নানা স্বীকৃতি ও পুরস্কার তৌহিদুল ইসলামকে কাজে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। তিনি চান আরও বড় পরিসরে কাজটি এগিয়ে নিতে।

যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন। এবং আমাদের সাথে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে।

এগুলো দেখুন

উদ্যোক্তা মন যেভাবে গড়ে তুলবেন

উদ্যোক্তা হতে হলে যা যা প্রয়োজন

উদ্যোক্তা হতে হলে যা যা প্রয়োজন আসুন এ বিষয়ে আজকে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক। উদ্যোক্তা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *