ইসতিসনা কি? ইসতিসনা এবং সালাম ও ইজারার মধ্যে পার্থক্য

ইসতিসনা কি? ইসতিসনা এবং সালাম ও ইজারার মধ্যে পার্থক্য । আসুন আজকে উল্লেখিত বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করা যাক। ইসতিসনা ক্রয়-বিক্রয়ের ভিন্ন প্রকার যে প্রকারে পণ্য অস্তিত্বে আসার পূর্বেই ক্রয়-বিক্রয়ে সংগঠিত হয়ে যায়। ইসতিসনা অর্থ হচ্ছে কোনো প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান (ম্যানুফ্যাকচারার) কে ক্রেতার জন্য নির্দিষ্ট জিনিস তৈরী করে দেওয়ার অর্ডার দেওয়া।

যদি তৈরিকারী (Manufacturer) প্রতিষ্ঠান নিজের পক্ষ হতে কাঁচা মাল দিয়ে ক্রেতার জন্য দ্রব্য তৈরি করে দেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করে নেয়, তাহলে ইসতিসনা চুক্তি অস্তিত্ব লাভ করবে। কিন্তু ইসতিসনা সঠিক হওয়ার জন্য অপরিহার্য হল, মূল্য উভয়ের সন্তুষ্টিতে নির্ধারিত করে নিতে হবে এবং কাংক্ষিত দ্রব্যের (যা তৈরি করা হবে) প্রয়ােজনীয় গুণাবলীও নির্ধারিত করে নিতে হবে।



ইসতিসনা চুক্তি দ্বারা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের উপর উক্ত দ্রব্য তৈরি করার ব্যাপারে চারিত্রিক দায়িত্ব অর্পিত হয়ে যায়। কিন্তু প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের কাজ শুরু করার পূর্বে উভয়পক্ষের যে কেউ অপরকে নােটিশ প্রদানের মাধ্যমে চুক্তি বাতিল করতে পারবে। কিন্তু প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের কাজ শুরু করার পর চুক্তিকে একতরফা বাতিল করা যাবে না।

ইসতিসনা কি? ইসতিসনা এবং সালাম ও ইজারার মধ্যে পার্থক্য

ইসতিসনা এবং সালামের মধ্যে পার্থক্য

ইসতিসনার এই পদ্ধতির প্রতি লক্ষ্য রেখে ইসতিসনা এবং সালামের মাঝে কয়েকটি পার্থক্য রয়েছে যা এখানে সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করা হচ্ছে।

১. ইসতিসনা সর্বদা এমন জিনিসের উপর হয় যা তৈরী করার প্রয়ােজন হয়, পক্ষান্তরে সালাম সকল জিনিসেই হতে পারে, চাই তা তৈরি করার প্রয়ােজন হােক কিংবা না হােক।

২. সালামে মূল্য সম্পূর্ণভাবে অগ্রিম পরিশােধ করা অপরিহার্য, পক্ষান্তরে ইসতিসনায় তা অপরিহার্য নয়।

৩. সালাম চুক্তি যদি একবার সংঘটিত হয়ে যায়, তাহলে তাকে একতরফা বাতিল করা যাবে না। পক্ষান্তরে ইসতিসনা চুক্তিতে দ্রব্য তৈরি শুরুর পূর্বে বাতিল করা যায়।

৪. সালামে পরিশােধের তারিখ ধার্য করা ক্রয়-বিক্রয়ের অন্যতম অংশ, পক্ষান্তরে ইসতিসনায় পরিশােধের তারিখ ধার্য করা অপরিহার্য নয়।

ইসতিসনা এবং ইজারার মধ্যে পার্থক্য

একথা স্মরণ রাখতে হবে যে, ইসতিসনা’য় প্রস্তুতকারক স্বয়ং নিজের মাল দ্বারা দ্রব্য তৈরি করার দায়িত্ব গ্রহণ করে নেয়, সুতরাং এই চুক্তি একথাকেও শামিল করে নেয় যে, কাঁচা মাল যদি প্রস্তুতকারকের নিকট না থাকে তাহলে সে তা জোগাড় করবে এবং কাংক্ষিত জিনিস তৈরির ক্ষেত্রেও কাজ করবে। যদি কাঁচা মাল গ্রাহকের পক্ষ হতে সরবরাহ করা হয়, প্রস্তুতকারক থেকে শুধুমাত্র তার শ্রম এবং দক্ষতা উদ্দেশ্য হয়, তাহলে তা ইসতিসনা চুক্তি হবে না। এক্ষেত্রে তা ইজারা চুক্তি হয়ে যাবে। যার মাধ্যমে কোন ব্যক্তি থেকে একটি নির্দিষ্ট বিনিময়ের মাধ্যমে সেবা গ্রহণ করা হয়।

যখন বিক্রেতা কাংক্ষিত জিনিস তৈরি করে ফেলবে, তখন তা ক্রেতার সামনে পেশ করবে। এই সময় ক্রেতা উক্ত দ্রব্য গ্রহণের ব্যাপারে অস্বীকার করতে পারবে কি না এ প্রসংগে ফিকহবিদদের বিভিন্ন দষ্টিভঙ্গী আছে। ইমাম আবু হানীফা (রহ.) – এর মাযহাব হলো, ক্রেতা উক্ত দ্রব্য দেখার পর তার (দর্শন ভিত্তিক ইখতিয়ার) এর অধিকার ব্যবহার করতে পারবে। কেননা, ইসতিসনা একটি ক্রয়-বিক্রয় আর যখন কোনো ব্যক্তি এমন কোনো জিনিস ক্রয় করে যা সে দেখে নি, তাহলে দেখার পর চুক্তি বাতিল করার ইখতিয়ার থাকে। এই উসূল ইসতিসনায়ও প্রযােজ্য হবে।



কিন্তু ইমাম আবু ইউসূফ (রহ.) বলেন, যদি তা (সরবরাহকৃত দ্রব্য) উভয়পক্ষের মাঝে চুক্তির সময় নির্ধারিত গুণাবলী অনুযায়ী হয়, তাহলে ক্রেতা তা কবুলের ব্যাপারে পাবন্দ হবে এবং সে দর্শনভিত্তিক ইখতিয়ার ব্যবহার করতে পারবে না।

উসমানী খেলাফতের যুগে ফিকহবিদগণ এই দৃষ্টিভঙ্গীকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং হানাফী বিধি-বিধান সেই অনুযায়ীই সংকলিত হয়েছে। কেননা, প্রস্তুতকারক তার যাবতীয় উপায়-উপকরণ কাংক্ষিত জিনিস তৈরির কাজে ব্যবহার করার পর ক্রেতা বিনাকারণে চুক্তি বাতিল করে দেওয়া আধুনিক শিল্প-বাণিজ্যে মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে। বিশেষত প্রস্তুতকৃত দ্রব্য সম্পূর্ণরূপে কাংক্ষিত গুণাবলী অনুপাতে হওয়া সত্ত্বেও।

সরবরাহের সময়

পূর্বে এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, ইসতিসনায় পণ্য সরবরাহের সময় নির্দিষ্ট করা অপরিহার্য নয়। তদুপরি ক্রেতা পণ্য সরবরাহের জন্য সর্বোচ্চ সময় ধার্য করতে পারবে। যার অর্থ হবে প্রস্তুতকারক যদি নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য সরবরাহে বিলম্ব করে, তাহলে ক্রেতা তা কবুল করার এবং মূল্য আদায়ের ব্যাপারে পাবন্দ হবে না।

পণ্য সময়মত সরবরাহ করার নিশ্চিয়তকল্পে এধরনের আধুনিক চুক্তি একটি শাস্তি হিসেবে গণ্য হয়। যার ফলে প্রস্তুতকারক যদি যথাসময়ে সরবরাহে বিলম্ব করে, তাহলে তার উপর জরিমানা আরােপ হবে, যা দৈনিক হিসাবের ভিত্তিতে করা হবে। শরীয়তের দৃষ্টিতে এ ধরনের কোন শাস্তি আরােপ করা যাবে কি না?

যদিও ফকীহদের ইসতিসনা প্রসংগে আলােচনাকালে এ প্রশ্নের ব্যাপারে চুপ থাকা পরিলক্ষিত হয়, কিন্তু তারা এ ধরনের শর্ত ইজারায় জায়েয বলেছেন। ফকীহগণ বলেন, যদি কোনো ব্যক্তি তার কাপড় সেলাইয়ের জন্য কোনো দর্জির সেবা গ্রহণ করে, তাহলে সরবরাহের মেয়াদ অনুযায়ী মজুরীতে কম-বেশি হতে পারে।

গ্রাহক (যিনি কাপড় সেলাই করাতে চান) একথা বলতে পারে যে, দর্জি যদি একদিনে কাপড় তৈরি করে দেয়, তাহলে তাকে এক’শ টাকা মজুরী দেয়া হবে, আর যদি দু’দিনে তৈরি করে দেয়, তাহলে আশি (৮০) টাকা দেয়া হবে।

এমনিভাবে ইসতিসনায় মূল্যকে সরবরাহের সময়ের সঙ্গে সংযুক্ত করা যাবে। উভয়পক্ষ যদি এ ব্যাপারে একমত হয়ে যায় যে, সরবরাহে বিলম্বের ক্ষেত্রে দৈনিক নির্দিষ্ট পরিমাণে মূল্য কমতে থাকবে, তাহলে এটা শরীয়তের দৃষ্টিতে জায়েয হবে।



ইসতিসনা পদ্ধতিতে অর্থায়ন

ইসতিসনাকে বিশেষ চুক্তিতে অর্থায়নের সহজতা লাভের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। বিশেষ করে হাউজ বিল্ডিং ফিন্যান্সের ক্ষেত্রে।

যদি গ্রাহকের নিজস্ব জমিন থাকে এবং সে গৃহ নির্মাণের জন্য অর্থায়ন চায়, তাহলে অর্থায়নকারী সেই খালি জমিনে ইসতিসনায়ের ভিত্তিতে গৃহ নির্মাণের দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে। আর যদি গ্রাহকের নিজস্ব জমিন না থাকে এবং সে জমিনও ক্রয় করতে চায়, তাহলেও অর্থায়নকারী এই দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারবে যে, সে তাকে এতটুকু জমিনে গৃহ নির্মাণ করে দিবে যা উভয়ের মাঝে পূর্বেই বিস্তারিতভাবে নির্ধারিত থাকবে।

ইসতিসনা যেহেতু মূল্য অগ্রিম পরিশােধ করা জরুরী নয় এবং পণ্য কজা করার সময়ও পরিশােধ করা জরুরী নয় (বরং উভয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যেকোনো সময় পর্যন্ত মূল্য পরিশােধে বিলম্ব করা যায়। এ জন্য উভয় পক্ষের চাহিদা অনুযায়ী মূল্য পরিশােধের তারিখ নির্ধারণ করা যাবে। মূল্য কিস্তিতেও পরিশােধ করা যাবে।

অর্থায়নকারীর জন্য নিজ হাতে গৃহ নির্মাণ করাও জরুরী নয়। বরং সে তৃতীয় কোন পার্টির সাথে প্যারালাল ইসতিসনা চুক্তিতেও অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে। কিংবা (গ্রাহক ব্যতীত) অন্য কোন ঠিকাদার থেকেও সেবা গ্রহণ করতে পারবে। উভয় ক্ষেত্রে সে ব্যয়ের হিসাব করে ইসতিসনা মূল্য নির্ধারণ এমনভাবে করতে পারবে যার ফলে ব্যয়ের উপর তার একটি যুক্তিসঙ্গত মুনাফা অর্জিত হয়।

এক্ষেত্রে গ্রাহকের পক্ষ থেকে কিস্তি পরিশােধ ঐ সময় থেকেই শুরু করা যাবে যখন উভয়পক্ষ চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে এবং নির্মাণ চলাকালীন ও বাড়ি গ্রাহকের হস্তগত হওয়ার পরও চালু রাখতে পারবে। কিস্তি পরিশােধ নিশ্চিতকল্পে জমিন কিংবা বাড়ি অথবা অন্য কোনো সম্পদের মালিকানা সর্বশেষ কিস্তি পরিশােধ পর্যন্ত অর্থায়নকারীর নিকট গ্যারান্টি হিসেবে রাখা যাবে।।

অর্থায়নকারীর দায়িত্ব হল, চুক্তিনামার বর্ণনা অনুযায়ী যথাযথভাবে গৃহ নির্মাণ করে দেওয়া। যেকোনো ধরনের ব্যবধানের পরিপ্রেক্ষিতে যেসব খরচ চুক্তির শর্তানুযায়ী বাড়ি তৈরিতে প্রয়ােজন হবে, অর্থায়নকারীকে তা বহন করতে হবে।



ইসতিসনা পদ্ধতিকে প্রজেক্ট অর্থায়নের (Project Financing) জন্যও উল্লেখিত নিয়মানুযায়ী ব্যবহার করা যাবে। যদি কোনো গ্রাহক তার ফ্যাক্টরীতে এয়ারকন্ডিশন প্লান্ট লাগাতে চায় এবং প্রান্ট তৈরির প্রয়ােজন হয়, তাহলে অর্থায়নকারী ইসতিসনা চুক্তির মাধ্যমে পূর্বে বর্ণিত পদ্ধতি অনুযায়ী প্লান্ট সরবরাহ করার দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারবে। এমনিভাবে ইসতিসনা চুক্তিকে কোন পােল-সেতু কিংবা মহাসড়ক নির্মাণের জন্যও ব্যবহার করা যাবে।

আধুনিক BOT চুক্তি (ক্রয়কর, চালাও এবং হস্তান্তরকর) কেও ইসতিসনার ভিত্তিতে আঞ্জাম দেওয়া যায়। যদি কোন দেশ একটি হাইওয়ে সড়ক নির্মাণ করতে চায়, তাহলে সে সড়ক নির্মাণের কোনো কোম্পানীর সাথে ইসতিসনা চুক্তি করতে পারবে এবং মূল্য হিসেবে তাকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত হাইওয়ে সড়ক চালানাে এবং টোল (toll) গ্রহণের অধিকার দেওয়া যাবে ।

যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে। 

এগুলো দেখুন

জীবনবিমায় প্রিমিয়াম, বোনাস এবং বার্ষিকবৃত্তি

জীবনবিমা: দাবি আদায় পদ্ধতি

জেনে নিন জীবনবিমা: দাবি আদায় পদ্ধতি সম্পের্কে। আসুন আজকে এ সম্পর্কে আলোচনা করে বিস্তারিত জেনে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *