লিসবন: ভাস্কো দ্য গামা ব্রিজ, বাইর আলতো

লিসবন: ভাস্কো দ্য গামা ব্রিজ, বাইর আলতো । লিসবনে পা রেখেছি দেখতে দেখতে চার দিন হয়ে যাচ্ছে। গতকালের সিটি ট্যুরের স্মৃতি এখনো টাটকা। এখনো মনের ক্যানভাসে আঁকা আছে বেলেম টাওয়ার, জেরোনিমাস মনস্ট্রারি কিংবা ডিসকভারি মনুমেন্টের ছবি। সুখের আবেশ নিয়েই বিছানা ছাড়লাম। আপাতত রূমমেট স্বপন দা ওয়াশ রুমে থাকায় স্যান্ডেলটা গলিয়ে লবিতে চলে এলাম। আমরা যে এলাকায় আছি তার নাম বাইশা চিয়াদো। লিসবনের পুরানো পাড়া বলতে যা বোঝায় তার মধ্যে চিয়াদো অন্যতম। আর আমাদের হোটেল বোর্জেস চিয়াদো ও অন্যতম হেরিটেজ হোটেল।

লিসবন: ভাস্কো দ্য গামা ব্রিজ, বাইর আলতো

এখন একটু অফ পিক টাইম, তারপরেও রুম ভাড়া কম করে হলেও বাংলাদেশি টাকায় প্রতি রাত প্রায় দশ হাজার টাকার মতো। অবশ্য এর মধ্যে কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট ধরা আছে। আমরাও সুযোগটার পুর্ন সদ্ব্যবহার করি। দুপুরে অধিকাংশ দিনই কনফারেন্সে ঘাস লতা-পাতা (ভেজিটেরিয়ান মিল) খেয়ে কাটাতে হয়, রাতের ডিনারও আর্লি করতে হয় বলে ঠিকমতো খাওয়া হয় না, তাই আমরা ব্রেকফাস্টটাকেই মেজর মিল বানিয়ে নিয়েছি। সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে ব্রেকফাস্ট সারি প্রতিদিন। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। ব্রেকফাস্টের টেবিলে দলনেতা সাইফুল ভাই জানিয়ে দিলেন আজ কনফারেন্সের পর আমরা ভিজিট করবো ভাস্কো দ্য গামা সেতু পাড়ি দিয়ে লিসবনের অপর পারে।



সেখানে ইউরোপের অন্যতম বিখ্যাত ফ্যাক্টরি আউটলেটে ঘুরে দেখার সাথে সাথে কেনাকানার সুযোগও মিলে যেতে পারে। আমারও আজ কিছু কাজ আছে কনফারেন্স হলে। কাল আমার পোস্টার প্রেসেন্টেশন আছে, তাই আজকের মধ্যেই পোস্টার মাউন্ট করতে হবে। একটু সকালে যেহেতু উঠেছি আর্লি ব্রেকফাস্টও করা হয়ে গেছে। আমাদের বাস আসতে এখনও বেশ কিছুটা সময় বাকি, তাই সিদ্ধান্ত নিলাম লিসবনের এই বিখ্যাত পাড়া বাইশা চিয়াদো একটু ঘুরে দেখি। রেডি হয়ে লবিতে নামতেই দেখি স্বপন দা আর বেলাল ভাইও তৈরি হয়ে আছে। তিনজনেই রাস্তায় বের হলাম।

শুরুতেই জানিয়ে রাখি আমাদের এই হেরিটেজ হোটেল বোর্জেস চিয়াদো সম্পর্কে। ১৮৮৪ সালে নির্মিত এই হোটেল লিসবনের অন্যতম পুরাতন হোটেল। ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মিশেল এই হোটেলে আধুনিক আরাম আয়েশের সব ব্যাবস্থাই বিদ্যমান আর সেই সাথে হোটেলটি ধরে রেখেছে তার সনাতন ঐতিহ্য। হোটেলের বিভিন্ন দেয়ালে মূর্ত হয়ে থাকা পুরনো লিসবনের ছবি সেই সাক্ষরই বহন করছে। লিসবনের ঐতিহ্য মোতাবেক ব্যালকনিসহ রুম আছে প্রায় কক্ষেই।

রুয়া গ্যারেট চিয়াদোতে অবস্থিত এই ঐতিহ্যবাহী হোটেলটি লিসবনের মুখ্য আকর্ষনগুলোর খুব কাছেই অবস্থিত। লিসবনের সিটি সেন্টার রসিও এখান থেকে পায়ে হেঁটে মাত্র ৫ মিনিটের পথ, একই কথা প্রযোজ্য পার্কা ডি কমার্সিওর ক্ষেত্রেও। খুব কাছেই মেট্রো স্টেশন বাইক্সা চিয়াদো। ফলে যাতায়াত নিয়ে ভাবনা নেই, আর বিখ্যাত ট্রাম ২৮ তো বুড়ি ছোঁয়া দূরত্বেই। প্রায় এক শতকেরও বেশি সময় ধরে ব্যবসা করে আসা এই হোটেলে বিভিন্ন সময়ে পা পড়েছে নানা বিখ্যাতজনের। অনেকে তো এক নিয়ে কবিতাও লিখেছেন, এই যেমন লিসবনের অন্যতম বিখ্যাত কবি ফার্নান্দো পেসোয়া বা ইনা ডি কুইরেস।

আমাদের হোটেলের ঠিক পাশেই আরেক বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট ক্যাফে ব্রাসিলেরিয়া, শুধু লিসবনেরই নয় ইউরোপেরই অন্যতম প্রাচীন ক্যাফে এটি। এখানেরই একটা টেবিলে বসে প্রতিদিন কফির পেয়ালায় চুমুক দিতেন আর কবিতা লিখতেন কবি ফার্নান্দো পেশোয়া, তার স্মৃতিকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে তার টেবিলে বসা একটা পাথুরে মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে এই ক্যাফের সামনে। আমরাও সুযোগে পেশোয়ার পাশের চেয়ারে বসে ছবি তুলে নিলাম।

লিসবন: ভাস্কো দ্য গামা ব্রিজ, বাইর আলতো

হেটে হেটে দেখে নিচ্ছিলাম এই প্রাচীন এলাকাকে। চারদিকে সব এন্টিক বাড়ির ছড়াছড়ি। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম প্রতিটি বাড়িই তার বাহিরের পুরাতন ঐতিহাসিক কাঠামো ধরে রেখে ভিতরের অংশকে আধুনিক ছাচে ঢেলে সাজিয়েছে। নিজেদের ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে লালন করার এই ঐকান্তিক প্রয়াস অজান্তেই মনকে ছুয়ে গেল। এক যায়গায় দেখলাম একটা নির্মানধীন বাড়িতে কিছু শ্রমিক কাজ করছে। এখানেও সেই একই দৃশ্য, বাহিরের দেয়ালটি অবিকল আগের মত রেখে ভিতরে পুনঃনির্মাণ চলছে।

শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম। এখানে মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন থেকেই পুরো বাড়ি ভাঙ্গার কোন পারমিশন নেই। শুধু পুনঃনির্মাণ করা যাবে তাও ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকে বিকৃত না করে। অজান্তেই এদের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে এলো। ইস আমরাও যদি পারতাম আমাদের পানাম নগর, সূত্রাপুর কিংবা শাঁখারি বাজারের ঐতিহ্যগুলোকে টিকিয়ে রাখতে।

হাঁটতে হাঁটতে দেখে নিলাম বেশ কিছু মিউজিয়াম। হাতে সময় আরো থাকায় আরো কিছুদূর হেঁটে পার্কা দ্য কমার্সিও ধরে নদীর তীরে চলে গেলাম, সেখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে রুয়া আগাস্তা ধরে লিসবন গেট পেরিয়ে আবার চলে এলাম রসিও স্কোয়ারে। এখান থেকেই আমাদের বাস ধরতে হবে। গত তিন দিনে আমার মায়ের মামাতো ভাই শুভ আর তার পার্টনার ফয়সাল মামা আমাদেরকে এই এলাকগুলো পায়ে হেঁটে ঘুরিয়েছেন, তাই আজ রাস্তা চিনতে আর কোন কষ্ট হলো না।

আসলে ইউরোপের অধিকাংশ সিটিতেই মুখ্য ট্যুরিস্ট আকর্ষণগুলো হেঁটেই ঘুরতে হয়। লিসবন বলেন, রোম বলেন আর প্রাগ সর্বত্রই একই দৃশ্য। আমাদের নির্দিষ্ট স্টপে পৌঁছে দেখি দলের অনেকেই বসে আছে, এখনো বাস এসে পৌঁছায়নি। এই সুযোগে আশে পাশের দোকানগুলোতে উইন্ডো শপিং করে বেড়ালাম। এখানেই একটা দোকানকে দাবি করা হয় ইউরোপের সবচেয়ে পুরাতন দোকান বলে।

সত্য মিথ্যা জানি না, তবে দেখে বেশ পুরাতনই মনে হলো, আর তাদের এন্টিক বইয়ের কালেকশনও বেশ সমৃদ্ধ মনে হলো। ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম আর দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলাম, সাধ আর সাধ্যের সমন্বয় কি আর সব সময় করা যায়। তারপরও লিসবনের ওপর একটা পেপার বুক কিনে নিলাম, যেটা এখন কাজে দিচ্ছে এই লেখা লেখার সময়।

লিসবন: ভাস্কো দ্য গামা ব্রিজ, বাইর আলতো

অল্পক্ষণ পরেই বাস চলে আসায় আর দেরি না করে বাসে উঠে বসলাম। বেশ কিছু স্ট্রিট ঘুরে পার্কা দ্য কমার্সিওর পাশ দিয়ে আমাদের বাস এগিয়ে চললো নদীর তীরের রাস্তা দিয়ে। রসিও থেকে পার্কা দ্যা কমার্সিও সোজা আসলে মাত্র কয়েক মিনিটের পথ, অথচ ওয়ান ওয়ে ট্র্যাফিকের কারণে আমাদের এটুকু পথ পাড়ি দিতেই ১৫ মিনিট লেগে গেল। অবশ্য কিছু করারও নেই। পুরানো শহরের রাস্তাগুলো খুব বেশি প্রশস্ত নয়, আবার সাথে ট্রামের লাইনও আছে, তাই এই ব্যবস্থা। নদীর পারে একটা জেটিতে দেখি প্রায় ১৫ তলা বিশাল এক প্রমোদতরী ভেড়ানো।

আমাকে সেদিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে আমাদের আজকের ড্রাইভার কাম-গাইড ডেভিড জানালেন এ ধরনের ক্রুজ শিপ সপ্তাহে দুই দিন এই জেটিতে ভিড়ে। এগুলোতে চড়ে ট্যুরিস্টরা সমুদ্রপথে ইউরোপের বিভিন্ন গন্তব্যে ঘুরে বেড়াতে পারেন। একেকটা শিপ যেন নিজেই একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ শহর। সুপার শপ থেকে শুরু করে, রেস্টুরেন্ট, বার, ড্যান্স ফ্লোর, বলরুম, সিনেমা হল, সুইমিং পুল, টেনিস কোর্ট সবই আছে সেখানে। রুমের ক্লাসের ভিত্তিতে ভাড়ার তারতম্য হয়। এখান থেকে বাল্টিক সাগর পাড়ি দিয়ে সুইডেন, নরওয়ে পর্যন্তও নাকি পৌঁছে যাওয়া যায়।

দেখতে দেখতে চলে এলাম মিও এরেনায়। আজকে কনফারেন্সের চতুর্থ দিন। আগামীকাল হবে ক্লোসিং সিরিমনি, তারই একটা অংশ হচ্ছে ম্যারাথন। এই ম্যারাথনের কয়েকটি পার্ট, মিনি, হাফ, ফুল আর আল্ট্রা ম্যারাথন। মিনি ম্যারাথন সম্ভবত ৭ কিমি, হাফ ২১ কিমি, ফুল ৪৩ কিমি আর আল্ট্রা ৫০ কিমির মতো।

আমাদের মধ্যে অনেকেই উৎসাহী হলেও শেষ পর্যন্ত কেউই আর এগিয়ে না আসায় আমার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রেজিস্ট্রেশন করলাম না। তার ওপর রানিং শু বা ড্রেস কিছুই নিয়ে আসিনি। শুধু শুধু সাময়িক উত্তেজনায় দৌড়াতে গিয়ে এই বিদেশ বিভুইয়ে ইঞ্জুরিতে পড়ার কোন মানে হয় না। তার মধ্যে যথাযথ প্রস্তুতি না নিয়ে ম্যারাথন দৌড়ালে হিতে বিপরীত হতে পারে।

কনফারেন্স সেন্টারে ঢুকে আমি সোজা চলে গেলাম পোস্টার হলে। সেখানকার স্বেচ্ছাসেবকদের সাহায্য নিয়ে পোস্টার মাউন্ট করে নিলাম। বিশাল এক হলে চলবে এই পোস্টার প্রতিযোগিতা। আমার মতো অনেকেই দেখলাম ব্যাস্ত শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে। এ ধরনের একটা ইন্টারন্যাশনাল প্রোগ্রামে প্রেসেন্ট করতে পারা একটা গৌরবের বিষয়। সারা বিশ্ব থেকেই সাইন্টিস্টরা তাদের গবেষণা লব্ধ জ্ঞান প্রেসেন্ট করতে এসেছেন এই প্রোগ্রামে।

কম করে হলেও ৫০০ এর মত পোস্টার প্রেসেন্ট হবে এবারের কনফারেন্সে। তাদের মধ্যে নিজের দেশকে রিপ্রেসেন্ট করতে খুবই আনন্দ হচ্ছে। কনফারেন্স সেন্টারের বাইরে অন্যান্য দেশের সাথে পত পত করে উড়তে থাকা আমাদের লাল সবুজ পতাকার কথা আরেকবার মনে পড়ে গেল। এই ধরনের বিশ্ব মাপের কনফারেন্সে পেপার এক্সসেপ্ট হওয়া অত্যন্ত ভ্যাগ্যের ব্যাপার। খুব ভালো মানের অথেন্টিক পেপার না হলে তারা এক্সসেপ্ট করে না।

আর এই ধরনের পেপার তৈরিতে যে অমানুষিক পরিশ্রম তা আজকে সার্থক বলে মনে হচ্ছে। এখানকার কাজ আপাতত সাঙ্গ করে বিভিন্ন হলে ঢুঁ মারলাম আর বিভিন্ন সায়েন্টিফিক আপডেট সম্পর্কে জেনে নিচ্ছিলাম। এর মাঝেই পরিচিত হলাম জার্মানির মেডিক্যাল শিক্ষার্থী ভিক্টরিয়ার সাথে। বার্লিন থেকে আসা ভিক্টরিয়া মূলত এখানে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ করছে। এখনোও গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেনি। ২০-২১ বছরের বেশ সুন্দরী তরুণী।

কথাবার্তায়ও বেশ স্মার্ট। আগামী বছরের প্রোগ্রাম হবে বার্লিনে, তার জন্য অগ্রীম দাওয়াত দিয়ে রাখলো আর সেই সাথে নিজের দেশের গুণগানও করল। আমিও সুযোগটা ছাড়লাম না নিজের দেশকে রিপ্রেসেন্ট করলাম। আমাদের দেশে যে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় হোয়াইট স্যান্ড বীচ, কক্সবাজার আর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, সুন্দরবনের অবস্থান সেকথা জানাতে ভুললাম না। ভিক্টোরিয়াও আগ্রহ দেখালো বাংলাদেশে আসার। ই-মেইল এড্রেস বিনিময় করে আশ্বাস দিয়ে রাখলাম বাংলাদেশে আসলে সবধরনের সহায়তার।

কাল আবার দেখা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবারের মতো বিদায় নিলাম। কয়েকটি সেশনে অংশ নিয়ে কনফারেন্স সেন্টারেই ঘাস লতা-পাতা (ভেজেটেরিয়ান মিল) দিয়ে লাঞ্চ সেরে দলের বাকিদের সাথে যুক্ত হলাম আগেই নির্ধারিত পয়েন্টে। দলের কয়েকজন পাশের শপিংমলে ঢুকে পড়েছিলেন, তাদের জন্য কছুটা সময় ব্যায় হল। অবশেষে সবাই একসাথে হলে আমরে রওনা হয়ে গেলাম ভাস্কো দ্য গামা ব্রিজের পানে।

লিসবনের ব্যাস্ততাকে পেছনে ফেলে বিভিন্ন অলি গলি ঘুরে আমরা ছুটে চললাম পন্টে ভাস্কো দ্য গামার উদ্দেশ্যে। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিল ব্রিজটির অবয়ব। এর পাশেই লিসবন টাওয়ার। এক্সপো ৯৮ উপলক্ষে ২৯ মার্চ ১৯৯৮ সালে উদ্বোধন হওয়া ১৭ কিমি দীর্ঘ এই সেতুকে বিবেচনা করা হয় বিংশ শতাব্দীর অন্যতম আর্কিটেকচারাল মাস্টারপিস হিসাবে।

১৪৯৮ সালে ভাস্কো দ্য গামার ভারতে পদার্পণের ৫শ বর্ষপূর্তি উদযাপনের অংশ হিসেবে নির্মিত এই ব্রিজ অনেকটাই ধনুকের মতো বাঁকানো। এর একটা অংশ অপর অংশের তুলনায় বেশ উঁচু। আমাদের আজকের গাইডের কাছ থেকে জানা গেল তাগুস নদীর এই অংশটায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছেদের বংশ বিস্তারে যাতে বাধা না পরে তাই এই ধরনের আয়োজন। তবে আমার কাছে মনে হলো এইখানটাতে নদীর স্রোতের তীব্রতার কারণে কিংবা বিশাল প্রমোদতরীগুলোর চলাচলের সুবিধার জন্যই এ কাজ করা হয়েছে।

ব্রিজ পার হওয়ার সময় আরেকটি অদ্ভুত বিষয় খেয়াল করলাম, অধিকাংশ ভেহিকেলই ব্রিজ টোল না দিয়েই পার হয়ে যাচ্ছে। অবাক হয়ে ড্রাইভারকে এ কথা জিজ্ঞেস করাতেই আমাকে সামনের ড্যাশবোর্ডের সাথে লাগানো একটা সাদা রঙের বক্সের দিকে দেখিয়ে দিল। আসলে এইটা একটা সেন্সর। এই সেন্সর লাগানো থাকলে অটো টোল দেয়া হয়ে যায় স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে। প্রি-পেইড কার্ডের মাধ্যমে এই বক্স রিচার্জ করে নেয়া যায় অথবা পোস্ট পেইড হিসাবে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকেও টাকা কেটে নেয়ার সুবিধা আছে।

দুই বছর পর স্পেনের এ মাথা থেকে ওমাথা চষে বেড়ানোর সময় এই বক্সের উপযোগিতা ভালোই টের পেয়েছিলাম। বাসে করে ব্রিজ পার হতে গিয়ে আরেকটি বিষয় খেয়াল করলাম ব্রিজের একদিকে চারটি লেন আর বিপরীত দিকে মাত্র দুইটি লেন। আবারো আমাদের গাইডের দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে জানালেন এই লেনগুলো পরিবর্তনশীল। এখন অফিস ছুটির সময় তাই সবাই অফিস শেষে বাড়ি ফিরছে, ফলে শহরের এক্সিট লাইনে গাড়ির চাপ বেশি, তাই এই সময় এক্সিট লাইনে দুইটি লেন বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে।

আবার সবার দিকে ইন লাইনে গাড়ির চাপ বেশি থাকে বলে তখন ইন লাইনে দুইটি লেন বাড়িয়ে ব্যাবহার করা হয়। লিসবনের অধিকাংশ মানুষই শহরের বাইরে থাকে। প্রতিদিন বাইরে থেকে মূল শহরে এসে কাজকর্ম সেরে আবার নিজের ডেরায় ফিরে যায়। দেখতে দেখতে পার হয়ে এলাম এই বিখ্যাত ব্রিজ।



ব্রিজ পার হতেই ওপারের একটা শহরের দিকে নির্দেশ করলেন আমাদের গাইড। এখানেই নাকি বিখ্যাত ফুটবলার লুইস ফিগোর জন্ম এবং বেড়ে উঠা। দেখতে দেখতে আমরা চলে এলাম ফ্রি পোর্টে, নাম বাইরো আলতো। এটাই নাকি ইউরোপের সবচেয়ে বিখ্যাত ফ্রি পোর্ট। এখান থেকেই নাকি ইউরোপে সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি রপ্তানি হয়। বিশেষ করে এশিয়া এবং আফ্রিকা থেকে বিভিন্ন পন্য প্রবেশ এবং বের হওয়ার গেটওয়ে হচ্ছে এই ফ্রি পোর্ট।

বাস আমাদের পার্কিং লটে নামিয়ে দিলে আমরা নিজেরাই ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম এই ভিন্ন ধরনের শপিং হাব। দুনিয়ার তাবত বাঘা বাঘা কোম্পানির সবাই হাজির নিজেদের ফ্যাক্টরির পণ্য নিয়ে। ডিউটি ফ্রি হওয়ায় এখানে দোকানের চাইতে জিনিসের দাম তুলনামূলক অনেক কম। কিন্তু আগেই জানিয়েছি আমার মতো হতদরিদ্র ট্যুরিস্টের জন্য আসলে এসব আউটলেট না। তারপরও অনেক সাহস সঞ্চয় করে সহধর্মিণীর জন্য কেল্ভিন ক্লেইন আর টমি হিলফিগার এর দুইটা ব্যাগ কিনেই ফেললাম।

ঘোরাঘুরি তো অনেক হলো এবার ফেরার পালা। আবার সেই ভাস্কো দ্য গামা ব্রিজ পার হয়ে লিসবন শহরের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে বাস আমাদের নামিয়ে দিয়ে গেল রসিও চত্বরে। রাতে আবার ডিনারের জন্য বের হতে হবে। কালকে কনফারেন্সে আমার পোস্টার প্রেসেন্টেনশন আছে, তারপর ছুটি, মানে বিদায়ের পালা। কিন্তু আমি কয়েকটা দিন থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছি তাই ছুটিও বাড়িয়ে রিটার্ন ফ্লাইট চেঞ্জ করেই এসেছি। দলের অনেকেই আবার এখান থেকে স্পেনে ঘুরে আসার প্ল্যান করেছে।

অনেকেই দেখলাম আজ রাতে এখান থেকেই মাদ্রিদ গিয়ে কাল সারাদিনে বেড়িয়ে আসার প্ল্যান করে ফেলেছে। স্পেন আর পর্তুগাল একেবারে পাশাপাশি রাষ্ট্র। উভয়েই সেঞ্জেনভুক্ত হওয়ায় ভিসার ঝামেলাও নেই। আমার তো আর এবার সে সুযোগ নেই; তাই আমি আর সেই দলে না ভিড়ে হোটেলের দিকেই পা বাড়ালাম… চলবে।

লেখক: আশরাফ উদ্দিন আহমেদ (শাকিল), চিকিৎসক, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল

যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে।

এগুলো দেখুন

‘নিউজিল্যান্ড পাড়ায়’ দেখবেন যেখানে

‘নিউজিল্যান্ড পাড়ায়’ দেখবেন যেখানে

জেনে নিন ‘নিউজিল্যান্ড পাড়ায়’ দেখবেন যেখানে । দেশের মধ্যেই রয়েছে নিউজিল্যান্ড পাড়া। নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছেন! …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *