জেনে নিন যানবাহন ও দুর্ঘটনা বিমা কী? দুর্ঘটনা বিমার প্রকারভেদ সমাপর্কে। আসুন আজকে এ সম্পর্কে আলোচনা করে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক। অগ্নিবিমা, নৌবিমা এবং জীবন বিমা ছাড়াও আরো অনেক রকম বিমার প্রচলন আছে যেগুলোকে বিবিধ বিমা (miscellaneous insurance) বলা হয়। নিচে বিবিধ বিমা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
- আরো পড়ুন: অগ্নি বিমা কী? অগ্নি বিমার বৈশিষ্ট্য ও প্রকারভেদ
- আরো পড়ুন: জীবনবিমা: দাবি আদায় পদ্ধতি
- আরো পড়ুন: ব্যাংক কাকে বলে বিস্তারিত জেনে নিন
যানবাহন ও দুর্ঘটনা বিমা কী? দুর্ঘটনা বিমার প্রকারভেদ
যানবাহন বিমা
আমাদের দেশ উন্নত হচ্ছে। সে সঙ্গে জীবনযাত্রার মান বেড়ে যাচ্ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যানবাহন। উন্নত বিশ্বে যানবাহন বিমা বাধ্যতামূলক। বর্তমানে আমাদের দেশেও এটিকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যানবাহন বিমা মূলত: গাড়ির বিপরীতে বিমা। একটা নির্দিষ্ট গাড়ির বিপরীতেই গাড়ি বিমা করতে হয়। কিন্তু গাড়ি বিমা আসলে কী সব বিষয়ে নিরাপত্তা দিচ্ছে?
সেসব বিষয় ভালোভাবে জেনে নেওয়া জরুরি বিমাপত্র করার পূর্বে। নিচে এসব বিষয়ের বিবরণ দেওয়া হলো:
- আঘাত ও মৃত্যুর জরিমানা: আপনার গাড়ি যদি দুর্ঘটনায় কাউকে আহত করে বা মৃত্যু ঘটায়, তবে ওই আঘাত বা মৃত্যুর বিপরীতে আপনার যে জরিমানা হবে ও আইন-আদালতে খরচ হবে, তার বিপরীতে বিমা সুবিধা থাকা প্রয়োজন।
- সম্পত্তি ধ্বংসের দায়: দুর্ঘটনায় আপনার গাড়ি যদি কারো সম্পত্তি ধ্বংসের কারণ হয়, তবে তার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়টি বিমা নিশ্চিত করছে কি না তা যাচাই করতে হবে। আপনার গাড়ির আঘাতে অন্যের ক্ষতিপূরণ করার জন্য third party বিমা বা তৃতীয় পক্ষ বিমা করা প্রয়োজন।
- চিকিৎসা খরচ: দুর্ঘটনায় আপনার গাড়ির আরোহী বা বাইরের কেউ আহত হলে তাঁদের চিকিৎসার খরচের জন্য বিমা করার ব্যবস্থা আছে। উন্নত বিশ্বে এটি বাধ্যতামূলক।
- সড়ক দুর্ঘটনা: সড়কে দুর্ঘটনায় আপনার গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হলে, তার বিপরীতে বিমা করার ব্যবস্থা রয়েছে।
- দুর্ঘটনা-বহির্ভূত ক্ষতি: সড়ক দুর্ঘটনার বাইরে নানা কারণ যেমন, চুরি, ভাঙচুর, আগুন, ঝড় এবং বন্যার মতো কারণে গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিমা করার ব্যবস্থা রয়েছে।
উপর্যুক্ত ক্ষতি নির্ধারণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে adjuster বলে।
বিমা পলিসির সামর্থ অনুযায়ী সব সুযোগ-সুবিধা আদায় করার জন্য সরকারি অ্যাডজাস্টারের সঙ্গে পরামর্শ করা প্রয়োজন। যদি বিমা দাবি ৩ মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি না হয় তাহলে কোম্পানির কাছে ব্যাখ্যা চাইতে পারেন। মনে রাখবেন, উল্লেখযোগ্য কোনো কারণ ছাড়া বিমা কোম্পানি ৩ মাসের মধ্যে দাবি পরিশোধ করতে বাধ্য। আর পরিশোধ না করলে ৩ মাসের পরবর্তী প্রতিদিনের বিলম্বের জন্য আপনি প্রচলিত ব্যাংক সুদের হারে মাসিক ভিত্তিতে আরো ৫ শতাংশ যোগ করে সুদসহ বিমা দাবি পাওয়ার অধিকার রাখেন।
উপরের আলোচনায় দেখা যায় যে, যানবাহন বিমার সাথে দুর্ঘটনা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
দুর্ঘটনা বিমা কী?
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকটা মহামারীর মতো। এটি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার জন্য নানা প্রচেষ্টা চলছে। এর বাইরেও আরো নানা ধরনের দুর্ঘনা সংঘটিত হয়।
দুর্ঘটনা হলো এমন ঘটনা যা অপ্রত্যাশিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় যার উপর মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, এমনকি যা হঠাৎ করে ঘটে। তাই দুর্ঘটনা কখন ঘটবে তাও পূর্ব থেকে বলা যায় না। এ বিষয়ে বিখ্যাত একটি মামলার রায় আছে। লর্ড ম্যাকনাগন Fenton বনাম Thorley (১৯০৩) মামলার রায় দেয়ার সময় বিচারপতি বলেন, “দুর্ঘটনা হলো কোনো অপ্রত্যাশিত খারাপ ঘটনা বা অপ্রত্যাশিত ঘটনা যা আশা বা চিন্তা করা যায় না”।
অপ্রত্যাশিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কারণে যে আর্থিক ক্ষতি হয় এবং তার নিরাপত্তার জন্য যে বিমা করা হয় তাকে দুর্ঘটনা বিমা বলে। এ ধরনের বিমা আপনি ব্যক্তিগত জীবনের জন্য ও সম্পত্তির জন্যও করতে পারেন।
দুর্ঘটনা বিমা প্রধানত ক্ষতিপূরণের বিমা। ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ চুক্তি অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ পাবে। এ বিমার ক্ষেত্রেও চূড়ান্ত বিশ্বাস ও বিমাযোগ্য স্বার্থ আবশ্যক।এবার আসুন, বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনা বিমা সম্পর্কে জেনে নিই।
দুর্ঘটনা বিমার প্রকারভেদ
দুর্ঘটনা বিমা ৩ প্রকার। যথা:
১. ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা বিমা
২. সম্পত্তির দুর্ঘটনা বিমা
৩. দায় বিমা।
নিচে এগুলোর বিবরণ দেওয়া হলো-
১. ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা বিমা (Personal Accident Insurance)
ব্যক্তিগত দুর্ঘটনার বিমার সাথে মানুষের কর্মদক্ষতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দুর্ঘটনা বা অসুখের কারণে বিমাগ্রহীতা মারা গেলে বা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে কর্মক্ষমতা হারালে যে ক্ষতি হয়, তা পূরণের জন্য বিমা করা হলে তাকে ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা বিমা বলে। এখানে ব্যক্তিগত দুর্ঘনা বিমা আবার কয়েক ধরনের হতে পারে। নিচে এগুলোর বিবরণ দেয়া হলো:
১. দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু বিমা
দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু বিমা অনুযায়ী যদি বিমাকৃত ব্যক্তি দুর্ঘটনায় মারা যায় বা দুর্ঘটনায় আহত হয়, তাহলে চুক্তি অনুযায়ী বিমাগ্রহীতা ক্ষতিপুরণ পাওয়ার অধিকারী হবেন। মারা গেলে তার নমিনি ক্ষতিপূরণের অর্থ পাবেন।
২. দুর্ঘটনাজনিত অক্ষমতা বিমা
কোনো দুর্ঘটনার কারণে বিমাকৃত ব্যক্তি সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে কর্মক্ষমতা হারালে বিমা চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট হারে বিমাকারীর নিকট থেকে ক্ষতিপূরণ পাবেন।
৩. নির্দিষ্ট রোগ ও দুর্ঘটনা বিমা
বিমাপত্র অনুযায়ী বিমাগ্রহীতা বিমা চুক্তিতে উল্লিখিত কোন রোগে আক্রান্ত হয়ে অক্ষম হয়ে পড়লে ক্ষতিপূরণ পাবেন।
৪. যেকোনো প্রকার রোগ ও দুর্ঘটনা বিমা
এ ধরনের বিমায় কোনো রোগের উল্লেখ থাকে না। দুর্ঘটনা ব্যতীত যেকোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে কর্মক্ষমতা হারালে তাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
৫. চিকিৎসা ও হাসপাতাল খরচ বিমা
যে বিমা পলিসিতে দুর্ঘটনা বা কোন রোগের কারণে হাসপাতাল ও চিকিৎসার খরচ বহন করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হলে তাকে চিকিৎসা ও হাসপাতাল খরচ বিমা বলে। উন্নত বিশ্বে এ ধরনের বিমার জন্য নানাবিধ কোম্পানি রয়েছে। এটি স্বাস্থ্য বিমা নামে পরিচিত। এটি প্রায় সকলের জন্য বাধ্যতামূলক। আমাদের দেশে এ প্রচলন সীমিত আকারে শুরু হয়েছে। জানা হলো স্বাস্থ্যবিষয়ক বিমা।
২. সম্পত্তির দুর্ঘটনা বিমা (Property Accident Insurance)
হঠাৎ দুর্ঘটনায় সম্পদের ক্ষতি হলে তা পূরণ করার জন্য বিমাগ্রহীতা ও বিমাকারীর মধ্যে যে চুক্তি সম্পাদিত হয়, তাকে সম্পত্তির দুর্ঘটনা বিমা বলা হয়। নৌ, অগ্নি ও জীবন বিমার বাইরে দুর্ঘটনার কারণে সম্পদের যে ক্ষতি সাধিত হয় তার বিপরীতে যে বীমা করা হয়, তাকে সম্পত্তির দুর্ঘটনা বিমা বলা হয়।
নিচে সম্পত্তি দুর্ঘটনা বিমা বা প্রোপারটি অ্যাকসিডেন্ট ইন্স্যুরেন্স (Property Accident Insurance) এর কয়েকটি ধরণ বা প্রকারের বিবরণ দেয়া হলো:
১. বিমান বিমা
বিমানের কোনো দুর্ঘটনার ফলে যে আর্থিক ক্ষতি হয় তা পূরণের উদ্দেশ্যে যে বিমা করা হয়, তাকে বিমান বিমা বলা হয়। বিমান বিমার সঙ্গে বিমানের যাত্রী, মালামাল ও বিমান দুর্ঘটনা স্থলের মানুষ ও সম্পদের ক্ষতিও অন্তর্ভুক্ত করা যায়। ইতোমধ্যে আমরা নেপালে বাংলাদেশের একটি বেসরকারি এয়ার লাইন্সের বিমান দুর্ঘটনার ভয়াবহতা দেখেছি। যাত্রীরা বিমা কোম্পানির কাছ থেকে নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। বিমান বিমা বাধ্যতামূলক।
২. প্রকৌশল বিমা
শিল্পে দুর্ঘটনার ফলে যন্ত্রপাতি ও কলকব্জার ক্ষতির বিপরীতে যে বিমা চুক্তি করা হয়, তাকে প্রকৌশল বিমা বলা হয়। বড়ো বড়ো প্রতিষ্ঠান, বয়লার, জেনারেটর, ক্রেন, ট্রান্সফরমার, লিফ্ট, ডিজেল ইঞ্জিন ইত্যাদির জন্য এ ধরনের বিমা গ্রহণ করা হয়। প্রকৌশল বিমার কারণে ভারী ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প সচল থাকে।
৩. প্লেট-গ্লাস বিমা
ডেকরেটরে ব্যবহৃত কাঁচের জিনিসপত্রের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য এ ধরনের বিমা করা হয়।
৫. চৌর্য বিমা
চুরি, ডাকাতি, রাহাজানির মাধ্যমে সম্পত্তির ক্ষতি হয়; এ ধরনের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যে বিমা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, তাই চৌর্য বিমা। ব্যাংকগুলো নগদ অর্থ বহনের ঝুঁকি এড়ানোর জন্য এ ধরনের বিমা করে থাকে।
৬. ছিনতাই বিমা
চলাচলের পথে স্বর্ণালংকার, টাকা-পয়সা, বহনযোগ্য জিনিসপত্র ছিনতাইয়ের ফলে যে আর্থিক ক্ষতি হয় তা পূরণের লক্ষ্যে যে বিমা করা হয়, তাকে ছিনতাই বিমা বলে।
৭. হিমাগার বিমা
পচনশীল দ্রব্যাদি হিমাগারে সংরক্ষণ করা হয়। হিমাগারে রক্ষিত মালামাল কোনো কারণে ক্ষতি হলে তার বিপরীতে আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাওয়ার লক্ষ্যে এ ধরনের বিমা করা হয়।
৩. দায় বিমা (Liability Insurance)
ধরুন, ভুল চিকিৎসার কারণে একজন ডাক্তারকে মোটা অংকের অর্থ জরিমানা করা হলো, এটাও দুর্ঘটনা। এ ছাড়া এটি একটি দায়। বিমার মাধ্যমে এ দায় এড়ানো যায়। দায় বিমাও একধরনের দুর্ঘটনা বিমা। শিল্প কারখানায় কাজের সময় শ্রমিক কর্মচারি দুর্ঘটনায় আহত বা নিহত হলে তার দায়দায়িত্ব মালিকের উপর বর্তায়। মালিক এ ধরনের দায়দায়িত্ব যখন বিমাকারীর নিকট হস্তান্তর করে, তাকে দায় বিমা বলে।
- আরো পড়ুন: রাশিয়ায় উচ্চশিক্ষাঃনিজেই করুণ আবেদন
- আরো পড়ুন: আয়ারল্যান্ডে উচ্চশিক্ষা: নিজেই করুণ, নিজের আবেদন
- আরো পড়ুন: খুব সহজেই নাগরিকত্ব পাবেন ৮ দেশে!
নিচে বিভিন্ন ধরনের দায় বিমার বর্ণনা দেওয়া হলো:
১. নিয়োগকারীর দায় বিমা
কারখানায় কতর্ব্যরত অবস্থায় কোন ধরনের দুর্ঘটনা বা ঐ শিল্প সংক্রান্ত কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে কোনো কর্মচারি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার দায় মালিকের উপর বর্তায়। মালিক পক্ষ বিমার মাধ্যমে এ দায় বিমা প্রতিষ্ঠানের উপর চাপিয়ে দিতে পারেন।
২. গণ দায় বিমা
মোটরগাড়ি, রেলগাড়ি বা বিমানে ভ্রম কালে কোন যাত্রী দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করলে অথবা যখম হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলে যাত্রীদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে আর্থিক সহায়তাদানের লক্ষ্যে পরিবহন মালিক যে বিমা করে তাকে গণ দায় বিমা বলে।
৩. পণ্য দায় বিমা
পণ্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তর করার সময় কোনো দুর্ঘটনায় পণ্য সামগ্রী ক্ষতি হলে তার দায় দায়িত্ব পরিবহন কোম্পানির উপর পড়ে। এ ধরনের দায়পরিবহন কোম্পানি বিমার মাধ্যমে বিমা কোম্পানির
উপর চাপিয়ে দিতে পারে।
৪. পেশাগত ক্ষতিপূরণ দায়
ক্ষতিপূরণ আইন অনুযায়ী কোনো কর্মী কোনো পেশাজনিত রোগে আক্রান্ত হলে মালিক আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য। এ ধরনের দায় বিমার মাধ্যমে বিমা কোম্পানির উপর চাপিয়ে দেয়া যায়।
যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন। এবং আমাদের সাথে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে।