জেনে নিন আপনার জন্য কোনটি সবচেয়ে উপকারী স্যানিটারি ন্যাপকিন নাকি মেন্সট্রুয়াল কাপ? আসুন এ বিষয়ে আলোচনা করে আজকে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক। সময় এখন ২০২২ সাল। পুরাতনকে পেছনে রেখে এগিয়ে চলছে নতুনত্ব। কুসংস্কার পিষে গিয়েছে আধুনিকতার পদভারে। তবে পিরিয়ড আজও কেন ট্যাবু? এখনো অনেকেই পিরিয়ডকে নারীর সীমাবদ্ধতা বলে আখ্যা দেন। পিরিয়ড হয় বলে নারীকে দুর্বল বলেন। কেউ কেউ তো আবার পিরিয়ডকে অপবিত্র মনে করেন। অথচ মায়ের গর্ভে এই পিরিয়ডের জমে থাকা রক্তে বেঁচে ছিলেন আপনি। পিরিয়ডের জন্যই একজন নারী হয় মমতাময়ী মা। তবু এখনও কোনো নারী ফার্মেসিতে গিয়ে অপেক্ষা করে ভিড় কমার, যাতে সে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসটি চাইতে পারে। ঘর থেকে বের হতেই মনে মনে প্রার্থনা করে কারো আড়চোখের চাহনি যাতে তার দিকে নিবদ্ধ না হয়। কারো কটুবাক্য শুনতে না হয়।
হ্যাঁ, শুধুমাত্র আপনার নিচুস্তরের মানসিকতার জন্যই আজও নারীরা ভীত। এবার থামুন! দৃষ্টিভঙ্গি বদলান। পিরিয়ড কোনো অশুচি জিনিস নয়। নিজে জানুন, অন্যকে জানতে সাহায্য করুন। মনে রাখবেন, আপনি সতর্ক হলে, সতর্ক হবে আপনার পরিজন।
প্রতি মাসেই পিরিয়ড নামক ট্যাবুর মুখোমুখি হতে হয় মেয়েদের। এই সময়ে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বস্তু স্যানিটারি ন্যাপকিন বা প্যাড। খরচের কথা ভাবতে গিয়ে অনেকে এখনও ব্যবহার করেন কাপড়, যা অস্বাস্থ্যকর তো বটেই, আবার মারাত্মক ক্ষতির কারণ। এদিক বিবেচনায় মেন্সট্রুয়াল কাপ আপনার জন্য সুখবর নিয়ে আসতে পারে।
- আরো পড়ুন: জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল মিস হলে করণীয় কী?
- আরো পড়ুন: জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি খাওয়ার ক্ষেত্রে যেসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে
- আরো পড়ুন: জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি যেসব নারী খেতে পারবে না
স্যানিটারি ন্যাপকিন নাকি মেন্সট্রুয়াল কাপ?
মেন্সট্রুয়াল কাপ কী?
মেন্সট্রুয়াল কাপের আরেক নাম ঋতুপাত্র, যা দেখতে অনেকটা ফানেলের মতো মেডিক্যাল গ্রেড সিলিকন, যা তৈরি হয় ল্যাটেক্স (একধরনের প্রাকৃতিক রাবার জাতীয় পদার্থ) বা থার্মোপ্লাস্টিক আইসোমার দিয়ে। ফানেল বা ঘণ্টাকৃতির কাপের একদিকে লম্বা একটি কান্ড বিদ্যমান, যার সাহায্যে মেন্সট্রুয়াল কাপটি যোনিপথে সহজে সেট করা যায়। আর আপনি ৪-৯ ঘন্টা নিশ্চিন্তে লিকেজ ছাড়াই ঘরে-বাইরে কাজ করতে পারেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইদানীং মেন্সট্রুয়াল কাপের ব্যাপারে সবাই জানলেও এর আগমন বহু আগেই। ১৯৭৩ সালে লিওনা চালমারস নামক এক আমেরিকান প্রথম রাবার দিয়ে মেন্সট্রুয়াল কাপ তৈরি করেন। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে এবং পরবর্তীতে রাবারের ঘাটতি দেখা দেয়ায় মেন্সট্রুয়াল কাপের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। তারপর সময়ের চাহিদায় সকলের সামনে আসে আজকের মেন্সট্রুয়াল কাপ।
ব্যবহার করবেন কীভাবে?
প্রথম কয়েকবার একটু ভয় ভয় লাগতে পারে সবারই। ব্যাপার না! একবার শিখে নিলে সর্বোচ্চ এক মিনিটে সেট করে ফেলতে পারবেন নির্ভয়ে। তাহলে চলুন প্রথমবার চেষ্টা করার পূর্বে ধাপগুলো জেনে নেয়া যাক।
প্রথমে মেন্সট্রুয়াল কাপের খোলা মুখ উপরের দিক করে হাতের তালুতে নিন। তারপর আরেক হাতের সাহায্যে মাঝখানে চ্যাপ্টা করে ধরে রাখুন। কাপটি ইংরেজি অক্ষর সি-র মতো ভাঁজ করার চেষ্টা করুন। শেষে শক্তভাবে ধরে যোনিপথে প্রবেশ করান। খোলা মুখটি নিরাপদে যোনিপথে প্রবেশ করার পর হালকা ঘোরান।
কাপটি নিজে থেকেই ভেতরে যাওয়ার পর খুলে যাবে। স্যানিটারি ন্যাপকিন বা টেম্পুনের মতো এটি রক্ত শুষে নেয় না। রক্ত কাপের মধ্যে ধারণ করে রাখে। কিন্ত লিকেজ হয় না। আর রক্ত ভেতরেও প্রবেশ করে না। এককথায়, তরল অবস্থায় একজায়গায় আটকে থাকে, যা আপনি কাপ বের করার পরই দেখতে পারবেন। তবে হাই ফ্লো থাকলে দিনে দুবার পরিষ্কার করে নিতে হবে সুবিধা অনুযায়ী। আর লো বা মিডিয়াম ফ্লো থাকলে সারাদিন থাকতে পারবেন। ব্যস, এটুকুই! আর আপনি আরামে প্যাডবিহীন মাসের পর মাস পিরিয়ড পার করে ফেলবেন। ভুলেই যাবেন লিকেজের ভয়।
সংরক্ষণ করবেন কীভাবে?
মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহারের পর পরিষ্কার গরম পানিতে ফুটিয়ে নিতে হবে। তারপর মুছে শুকনো জীবাণুমুক্ত স্থানে সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। তবে কাপ ব্যবহারের আগে এবং ব্যবহারের সময় অবশ্যই হাত পরিষ্কার করে নিতে হবে। তা না হলে জীবাণুর সংক্রমণ হতে পারে আপনার শরীরে। সাবধান থাকা উচিত।
মেন্সট্রুয়াল কাপের সুবিধা কী কী?
- পিরিয়ডের সময় কাপড় ব্যবহার করা অস্বাস্থ্যকর। এজন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরুপ- প্রতি মাসে স্যানিটারি ন্যাপকিন গড়ে ৫০ থেকে ৬০ টাকা হলে বছরে খরচ হয় ৬০০ থেকে ৭২০ টাকা। ৬ বছরে খরচ হয় চার হাজার টাকার কম বেশি। আর একটি মেন্সট্রুয়াল কাপ কিনতে খরচ হয় ১,৮০০ থেকে ২,০০০ টাকা, যা ব্যবহার করা যায় একটানা ৮ থেকে ১০ বছর।
- স্যানিটারি ন্যাপকিন বা টেম্পুন ব্যবহারে পরিবেশ দূষণ হয় বেশি। এক্ষেত্রে সিলিকন মাটিতে মিশে যায় না বলে স্বাস্থ্যঝুঁকি হতে পারে ছিন্নমূল মানুষ তথা প্রাণীদের। এজন্য মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার পরিবেশবান্ধব।
- অন্তর্বাস পরিধানের প্রয়োজন হয় না।
- বিষক্রিয়া বা যৌনাঙ্গ সংক্রমিত রোগব্যাধি হওয়ার সুযোগ নেই।
- ভেজা, স্যাঁতসেঁতে ভাবের ঝামেলা নেই।
- লিকেজ হয় না। পিরিয়ডকালীন একজন নারীর শরীর থেকে ২৫ থেকে ৩০ মিলি রক্ত নির্গত হয়। প্যাড থেকে লিকেজ হয় হরহামেশা। কিন্ত মেন্সট্রুয়াল কাপের ধারণক্ষমতা ৬০ মিলি।
মেন্সট্রুয়াল কাপ নিয়ে যত ভ্রান্ত ধারণা-
- ঋতুপাত্র ধারণ করলে সতীত্ব নষ্ট হবে। কিন্তু ঋতুপাত্র ব্যবহার করলে আঘাতের সম্ভাবনা নেই। তাই এটি ভাবা উচিত নয়।
- মেন্সট্রুয়াল কাপ যোনীপথে সেট করলে কোথাও হারিয়ে যাবে। সার্জারি করে বের করতে হবে। এটিও সঠিক নয়। নারীদের যোনিপথ ৩ থেকে ৬ ইঞ্চি লম্বা হয়। যার শেষপ্রান্তে জরায়ু অবস্থিত। অর্থাৎ, যোনীপথের সামনের দিকটিই খোলা। তাহলে কাপ হারানোর জায়গা কোথায়?
- মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করলে নষ্ট হয়ে যাবে এবং আবার কিনতে হবে। ভালো মানের কাপ কিনলে টানা ৮ থেকে ১০ বছর ব্যবহার করা যায়।
- মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করলে মল-মূত্রত্যাগ করা যায় না। নিজের শরীর সম্পর্কে জানুন, তারপর না হয় এসব ভাববেন।
- মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যথার কারণ হতে পারে। মূলত এটি সিলিকন দিয়ে তৈরি। এজন্য ব্যথা হওয়ার সম্ভাবনা কম। গবেষণা অনুযায়ী, প্রথমে একটু অস্বস্তি লাগলেও পরে স্বাভাবিক মনে হয়।
- আরো পড়ুন: দুর্গন্ধ কীভাবে দূর করবেন
- আরো পড়ুন: প্রস্রাবের রঙ স্বাস্থ্য সম্পর্কে বলে দিবে
- আরো পড়ুন: সিজার কতবার করা নিরাপদ?
মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহারের আগে খেয়াল রাখতে হবে
আপনার বয়স, শারীরিক গঠন, বৈবাহিক সম্পর্ক ইত্যাদি ভেদে মেন্সট্রুয়াল কাপের আকার ভিন্ন হবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, কিশোরী নারীর জন্য ছোট এবং বিবাহিত নারীদের জন্য বড় কাপ ব্যবহার করা উচিত। এতে জটিলতা কম হয়। তাছাড়া জরায়ু ইনফেকশন, সিস্ট, অন্যান্য স্বাস্থ্যগত সমস্যা থাকলে ব্যবহার না করাই শ্রেয়। যাদের হাই ফ্লো আছে, তারা ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকবেন। ডাক্তারের পরামর্শ নিলে ভালো হয়। আর এটি কেনার আগে অবশ্যই ব্র্যান্ড, উপাদান, মেডিক্যাল গ্রেড ইত্যাদি বিষয় দেখে কিনবেন।
সবকিছু ভালো করে বিবেচনা করে আপনি সিদ্ধান্ত নেবেন কোনটি আপনার উপযোগী। কারো কথায় নয়। কারণ স্বাস্থ্য আপনার, সিদ্ধান্তও আপনার। যদি থাকেন আপনি সুস্থ, সুস্থ জীবন পাবে ভবিষ্যত প্রজন্ম।
যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন। এবং আমাদের সাথে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে।